খাবারের দোকানপাটের ভিড়ে আবাসিক এলাকা খিলগাঁওকে আলাদা করে এখন চেনাই মুশকিল। তবে সুসজ্জিত এসব দোকান, রেস্তোরাঁগুলোই এখন হয়ে উঠেছে খিলগাঁও-তালতলাবাসীর আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি তথা বিনোদনের অন্যতম স্থান
খাবারের দোকানপাটের ভিড়ে আবাসিক এলাকা খিলগাঁওকে আলাদা করে এখন চেনাই মুশকিল। তবে সুসজ্জিত এসব দোকান, রেস্তোরাঁগুলোই এখন হয়ে উঠেছে খিলগাঁও-তালতলাবাসীর আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি তথা বিনোদনের অন্যতম স্থান

খাওয়াদাওয়া কেনাকাটাতেও জমজমাট খিলগাঁও

  • খিলগাঁও আবাসিক এলাকার ভেতরে যাঁরা আগে আসেননি, তাঁদের কাছে প্রথম দর্শনে বেশ চমকপ্রদ মনে হবে।

  • খিলগাঁও তালতলা সুপার মার্কেটের সামনের এই সড়কটির দুই পাশের খাবারের দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে জমজমাট পরিবেশ দেখা যায়।

পূর্ব-পশ্চিম দুই দিকে দুটি রেলক্রসিং। পাশ দিয়ে অতীশ দীপংকর সড়ক। তবে রাজধানীর মানুষজন একে বিশ্বরোড বলেই চেনেন। এই সড়কের সমান্তরালে খিলগাঁও রেলক্রসিং থেকে শুরু করে এলাকার ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের কাছাকাছি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বিশ্বরোডে গিয়ে মিলেছে শহীদ বাকি সড়ক। বেশ চওড়া এই সড়কটি অধুনা খাদ্যরসিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হরেক রকম খাবারের দোকানের জন্য। চায়নিজ থেকে শুরু করে ভারতীয়, মোগলাই থেকে দেশি চুইঝালের গরুর মাংস, কাবাব থেকে কাচ্চি, রসগোল্লা-চমচম, চা-কফি কী নেই এখানে!

খিলগাঁও ঢাকার একটি প্রাচীন এলাকা। অধুনা বিলুপ্ত পাণ্ডু নদের তীরে খিলগাঁও এলাকাটি তখন ছিল নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক এলাকা। অনাবাদি পতিত ভূমি ছিল অনেক। অনাবাদি জমিকে ‘খিল’ বলা হতো। সেই থেকে এই গ্রামীণ এলাকাটির ‘খিলগাঁও’ নামকরণ বলে মনে করা হয়। কালক্রমে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে।

আধুনিক পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে খিলগাঁও গড়ে তোলা হয় গত শতকের ষাটের দশকে। এটি রাজধানীর পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোর একটি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তৎকলীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি), বর্তমানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) খিলগাঁও আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। সে সময় ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন কমলাপুরে স্থানান্তর করা হয়েছিল। খিলগাঁও আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রধান লক্ষ্য ছিল কমলাপুরের বাসিন্দা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আবাসনের ব্যবস্থা ও শহরের উত্তরমুখী সম্প্রসারণ করা।

একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও খিলগাঁওয়ের মূল মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, তা সত্ত্বেও এলাকার ভেতরের প্রশস্ত রাস্তা ও ফুটপাত, সারিবদ্ধ আবাসিক ভবন, অনেক গাছপালা, ছিমছাম পরিবেশ খিলগাঁও এলাকাটিকে সৌন্দর্য ও আভিজাত্য এনে দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের একটি বড় খেলার মাঠও আছে। খিলগাঁও আবাসিক এলাকার ভেতরে যাঁরা আগে আসেননি, তাঁদের কাছে প্রথম দর্শনে বেশ চমকপ্রদ মনে হবে।

আবাসিক এলাকার পাশাপাশি খিলগাঁও বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। এখানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ব্যাংক-বিমা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারসহ অসংখ্য হোটেল–রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। দুপুরের পর থেকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খিলগাঁও তালতলা সুপার মার্কেটের সামনের এই সড়কটির দুই পাশের খাবারের দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে তরুণ-তরুণী ও আশপাশের এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে জমজমাট পরিবেশে সৃষ্টি হয়।

এখানে প্রথম দিকের খাবারের দোকানের মধ্য ভূতের আড্ডা, পালকি, ব্লুমুন, পিঠাঘর অন্যতম। সম্প্রতি এক বিকেলে পিঠাঘরের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম জানালেন, ফুটপাতের পাশের দোকান থেকে বহুতল অভিজাত বাণিজ্যিক ভবনের জাঁকজমকপূর্ণ রেস্তোরাঁ মিলিয়ে প্রায় তিন শর মতো খাবারের দোকান আছে এই এলাকায়। বার্গার, পিৎজা, পাস্তা থেকে ডাল, ভর্তা–ভাজিসহযোগে সাদা ভাত সবই পাওয়া যাবে। প্রধানত শীতকাল পিঠার মৌসুম হলেও তাদের পিঠাঘরে এখন নারকেলপুলি, পাটিসাপটা, বাঁশপাতা, মালপোয়া ও নকশি পিঠা পাওয়া যায়। দাম প্রতিটি ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। যাঁরা ভারতীয় খাবারে আগ্রহী, তাঁদের জন্য আছে দোসা, ছোলাবাটুরা, রাজকচুরি প্রভৃতি। ফুচকাপ্রেমীরা নিতে পারেন দই–ফুচকার স্বাদ।

নানা পদের মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় খিলগাঁও–তালতলার এসব দোকানপাটে

চায়নিজ রেস্তোরাঁ আছে ব্লুমুন, গোল্ডেন গেট, চায়নিজ ওয়ার্ল্ড, অলিভার্সসহ অনেকগুলো। মোশিন চায়নিজের কাউন্টার ব্যবস্থাপক মো. সোহেল জানালেন, দুপুরের পর থেকেই চায়নিজ রেস্তোরাঁগুলোয় অতিথির সংখ্যা বাড়তে থাকে। খিলগাঁওয়ের চারপাশে বাসাবো, মুগদা, সিপাহিবাগ, মালিবাগ, রামপুরার মতো  অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা তাঁদের নানা উপলক্ষ, আয়োজনে এখানে খেতে আসেন। ফলে খাবার দোকানগুলোয় ক্রেতার অভাব হয় না।

চায়নিজ ছাড়াও কাচ্চি ভাই, সিরাজ চুই গোশত, ফ্রেন্ডস চুই অ্যান্ড কাটারিং, দিল্লি দরবার, ইন্ডিয়ান ফুডের মতো খাবার দোকানগুলোয় কাচ্চি, চিকেন, প্লেন বিরিয়ানি, তেহারি, খিচুড়ি, দেশি মাছ, ডাল, ভর্তা, ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া যায়। দিল্লি দরবারের ব্যবস্থাপক মো. শাহ জালাল জানালেন, তাঁরা দোকান খোলেন বেলা দুইটা থেকে। বন্ধ হয় রাত ১১টায়। সড়কসংলগ্ন তাঁদের মূল দোকানের ভেতরে বসে খাবারের পাশাপাশি ফুটপাতের পাশ দিয়ে সুদৃশ্য টেবিল–চেয়ার পাতা আছে। অনেকেই খোলামেলা পরিবেশে খেতে পছন্দ করেন।

বিকেল থেকে কাঠকয়লার আগুনে ঝলসে কাবাব তৈরি শুরু হয়ে যায় ফুটপাতঘেঁষা কাবাবের দোকাগুলোয়। মসলা মাখানো পোড়া মাংসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। সম্প্রতি এক বিকেলে ইয়াংসি কাবাবের দোকানে কাবাব-তন্দুরি খেতে এসেছিলেন তালতলা এলাকার গৃহবধূ শিখন কবীর। তিনি জানালেন, দুপুরের দিকে তালতলা মার্কেটে এসেছিলেন কেনাকাটা করতে। এর মধ্য শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি। এদিকে বেলাও প্রায় গড়িয়ে গেছে। তাই কাবাব-তন্দুরি দিয়েই দুপুরের আহার সেরে নিতে এখানে এসেছিলেন তিনি। এখানে খাবার বেশ সুস্বাদু। মাঝেমধ্যেই আসেন। এই কাবাবের দোকানের ব্যবস্থাপক মো. সানাউল্লাহ জানালেন, তাঁরা দুপুর ১২টা থেকে দোকান খোলেন। তাঁদের এখানে বিফ শিক, খিরি, চাপ, চিকেন বটি, টিক্কা, টেংরি কাবাব পাওয়া যায়। এখানে কাবাবের বড় দোকানগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে শাহিন স্পাইসি কাবাব, কাবাব হাউস, লাইভ চিকেন, রোড সাইড চিকেন, ক্রিস্পি চিকেন, হলি স্পাইস এগুলো।

কেএফসি, ডোমিনোস, হারফি, বিএফসি, সিপি ফাইভ স্টার, কুপার্স, মি. বেকার, টেস্টি ট্রিটসহ অনেক খ্যাতনামা খাবারের দোকানের শাখা আছে খিলগাঁয়ের এই সড়কের উভয় পাশে। চা, কফি, জুস পাওয়া যাবে চা-ঘর, উৎসব, কফি লাইমের মতো দোকানে। কফি লাইমের ব্যবস্থাপক মমিনুল ইসলাম জানালেন, তাঁদের এখানে খুব জনপ্রিয় ‘মিন্ট লেমনেড’; প্রতি গ্লাস ৪০ টাকা। পাওয়া যায় অনেক রকম মৌসুমি ফলের রস। আর মিষ্টিমুখ করতে যেতে পারেন মিঠাই, মুসলিম, ভাগ্যকুল, টাঙ্গাইলের বিখ্যাত সব মিষ্টির দোকানে।

খাবারের দোকানের পাশাপাশি অধিকাংশ খ্যাতনামা পোশাকের দোকানও রয়েছে এখানে। গড়ে উঠেছে অনেক বহুতল বিপণিবিতান। সেখানে জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় হরেক পণ্যের বিপুল সমারোহ। আশপাশের বাসিন্দারা নিয়মিত কেনাকাটা করতে আসেন এখানে।

এই এলাকার প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও গড়ে উঠেছে খিলগাঁওয়ের সড়কটির দুই পাশে। পল্লীমা সংসদ, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও সরকারি মডেল কলেজ, খিলগাঁও সরকারি মডেল হাইস্কুল, কোয়ালিটি এডুকেশন স্কুলের পাশাপাশি বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শাখাও রয়েছে। ফলে সকাল থেকে বিকেল অবদি কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের যাতায়াতে ব্যতিব্যস্ত থাকে চারপাশ। আর তারা পড়ালেখা, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়ায় মুখর করে রাখেন খিলগাঁও এলাকা।