
ক্রেতারা আগে দেখেন মা–বাবাকে, তারপর বুকিং দেন বাচ্চা কিনতে, বাচ্চা জন্মের আগেই। মাইক, হিরো, বেহুলা, জরো, টম, ব্র্যান্ডি, আকিরা, বাবুস্কা, লিও, টুইংকেল, কিং অরিওসহ অন্যান্য জার্মান শেফার্ড এবং ইতালিয়ান ম্যাসটিফ, ইংল্যান্ডের বুল ম্যাসটিফ কুকুরের বাচ্চা কেনার জন্য এ বুকিং। এই কুকুরগুলোকে ‘গার্ড ডগ’ বা পাহারাদার কুকুর নামে চেনে সবাই।
মায়ের পেটে থাকতেই বিক্রি হয়ে যাওয়া কুকুরগুলোকে জন্মের পর তিন মাস থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। পাঁচ মাস বয়স থেকেই পাহারাদারের দায়িত্ব নিতে পারে এগুলো। জার্মান শেফার্ডের বাচ্চা বিক্রি হয় ৪০ হাজার টাকায়, ইতালিয়ান ও ইংল্যান্ডের ম্যাসটিফ ৬০ হাজার টাকায়।
এসব তথ্য পাওয়া গেল রিয়াদ মাহমুদ শাওনের কাছে। পাহারাদার কুকুরের বাচ্চা উৎপাদন ও বিক্রির জন্য ২০১৮ সালে একটি খামার গড়ে তোলেন তিনি, নাম ‘শাওনস কেনেল’। খামারটি রাজধানীর খিলগাঁও থানার ত্রিমোহিনী ইটাখোলা এলাকায়। শুরুতে বিদেশ থেকে কুকুর আমদানি করেন রিয়াদ, পরে খামারেই প্রজনন ঘটান। এখানে এখন ২৬টি বড় কুকুর আছে। তার একটি সবে মা হয়েছে, আরেকটি হবে। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার আগে কিংবা পরপরই বিক্রি হয়ে যায় বলে সেগুলো কমই থাকে।
অনেকেই বলেন আমি কুকুর নিয়ে পাগলামি করছি। তবে কিছু করার নেই। এগুলোকে এখন আর কুকুর বলে মনে হয় না। এগুলো আমার সন্তানের মতো। এগুলোকে আমি বাচ্চা বলেই ডাকি।রিয়াদ মাহমুদ, মালিক, শাওনস কেনেল
কয়েকটি কুকুরছানা দেখিয়ে রিয়াদ মাহমুদ বললেন, সবগুলোই বিক্রির জন্য বুকিং হয়ে গেছে। কুকুরগুলোর গর্ভকাল ৬৪ দিন। একসঙ্গে আট থেকে নয়টি বাচ্চা দেয়। তবে মায়ের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বছরে একবার প্রজনন ঘটানো হয়।
তিনি জানান, এই কুকুরগুলোর একেকটির ঘাড় পর্যন্ত উচ্চতা ৩১ ইঞ্চির মতো। দুই পায়ে দাঁড়ালে প্রায় ছয় ফুটের মতো হয়। লাফ দিয়ে ১১ থেকে ১৫ ফুটের দেয়ালও ডিঙাতে পারে এগুলো। জার্মান শেফার্ডের ওজন হয় ৫০ থেকে ৬০ কেজি আর ইতালিয়ান ম্যাসটিফের ওজন ৮০ থেকে ১২০ কেজি। একেকটি পাহারাদার কুকুর ১২ থেকে ১৫ বছর নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতে পারে। এরপর বয়স্ক হয়ে গেলে তখন আর এ কাজ করতে পারে না।
বছরে ৭০ থেকে ৮০টি বাচ্চা বিক্রি করে ‘শাওনস কেনেল’। বুকিং দেওয়ার সময় ৫০ শতাংশ এবং বাচ্চা নেওয়ার সময় বাকি টাকা দিতে হয় ক্রেতাকে। কুকুরছানাগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) বাহিনীর জন্য। বাসাবাড়ি–কারখানা পাহারা দেওয়ার জন্যও কেনেন অনেকে।
পাহারাদার এই কুকুরগুলোর একেকটির ঘাড় পর্যন্ত উচ্চতা ৩১ ইঞ্চির মতো। লাফ দিয়ে ১১ থেকে ১৫ ফুটের দেয়ালও ডিঙাতে পারে এগুলো। ওজন ৫০ কেজি থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত হয়। ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় প্রতিটি কুকুরছানা।
মানুষ কেন এমন হিংস্র কুকুর কেনায় আগ্রহী হচ্ছে—এ প্রশ্নে রিয়াদ বলেন, ‘চারপাশে মব, ধর্ষণসহ নানা ঘটনা ঘটছে। আমি নিজে জানি, আমার মেয়ের সঙ্গে একটা জার্মান শেফার্ড থাকলে মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে আর ভাবতে হবে না, এই কুকুরই মেয়েকে সুরক্ষা দেবে। একইভাবে বড় ব্যবসায়ীসহ অন্যরা কারখানা পাহারা দেওয়ার জন্য কিনছেন। কুকুর ঘুষ লেনদেন বোঝে না, তাই ওকে ভরসা করা যায়।’
যেভাবে কুকুরের খামার
রিয়াদ মাহমুদ ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে জার্মান শেফার্ডসহ বিভিন্ন পশুপাখির সঙ্গে বড় হয়েছেন। রাজধানীর মুগদায় গ্রিন মডেল টাউন ফ্ল্যাটে ব্যবসার জন্য কুকুর লালন–পালন শুরু করেছিলেন। তবে আশপাশের মানুষের নানা অভিযোগ থাকায় সেখানে থাকা সম্ভবপর হয়নি। পরে ইটাখোলার খোলা এলাকায় চার কাঠা জমি কিনে ব্যবসা শুরু করেন। কুকুরের থাকার জায়গার পাশেই একতলা কয়েকটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি।
ইটাখোলা এলাকাটিকে ঢাকার মধ্যে প্রত্যন্ত গ্রাম বললেও খুব একটা ভুল হবে না। চারপাশে বালু নদ, ডোবা–নালা। বালু নদে বড় নৌকা চলে। এলাকার মাটির সরু ও ভাঙা সড়কে দুই–একটা অটোরিকশাও দেখা যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া সেখানে গেলে ফেরার পথে ভোগান্তি হবেই।
গত সপ্তাহে এক দুপুরে খামারে ঢোকার আগেই কুকুরের সমস্বরে চিৎকারের শব্দ ভেসে এল। ঢোকার পর রিয়াদ মাহমুদ বললেন, আগন্তুকদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে। এমনিতেও ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। বিশেষ করে পুরুষ কুকুর আরেক পুরুষ কুকুরকে সহ্য করতে পারে না। তবে নারী কুকুর নারী কুকুরের সঙ্গে ঝগড়া কম করে। বয়স্ক কুকুর বেশ দাপট নিয়ে চলার চেষ্টা করে।
হিংস্র ও ক্ষিপ্র এই কুকুরগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেনে বিজিবি, পিবিআই, এসএসএফ বাহিনীর জন্য। বাসাবাড়ি-কারখানা পাহারা দেওয়ার জন্যও কেনেন অনেকে।
আস্তে আস্তে চিৎকারের মাত্রা কিছুটা কমে এলে কুকুরের ঘরগুলোর কাছে যাওয়া হলো। রিয়াদ মাহমুদ, স্ত্রী লুবনা ইয়াসমীন এবং ছেলে এ লেভেল সম্পন্ন করা ইল্লিন মাহমুদ আরিয়ান এদের দেখাশোনা করেন। এদের হিংস্র আচরণের কথা চিন্তা করে এবং যদি ভালো না বেসে কাজ করেন, সে ভয় থেকে কোনো কর্মী রাখেননি রিয়াদ মাহমুদ। তাঁর ১১ বছর বয়সী মেয়ে সানজিদা মাহমুদ এখানে থাকে না, সে তার নানার বাড়ি থাকে।
উৎপাদন ও বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এখন ইটাখোলার এ জায়গাতেও আর কুলোচ্ছে না, তাই পাশেই ১১ কাঠার আরেকটি জমি কিনে সেখানে কুকুরের থাকার জায়গা বানাচ্ছেন রিয়াদ মাহমুদ।
‘বাচ্চা’ বলেই ডাকেন
খামারে লোহার গ্রিলের খাঁচার কাছাকাছি যেতেই একেকটি কুকুর যেভাবে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠছিল, তাতে যে কারও মনে ভয় ধরাবে। তবে রিয়াদ মাহমুদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কাছে গেলে আদর পাওয়ার জন্য একেকজনের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কুকুরগুলো। জিব বের করে শরীর চেটে দেওয়া, এমনকি নাম ধরে ডেকে হাত বাড়িয়ে দিলে তাও ধরছিল। ‘বেহুলা চুপ’ বললে কেমন যেন একটু চুপ করে যায়। খাঁচার মধ্যে ঢুকতে বলা হলে গড়িমসি না করেই পালন করে সেই আদেশ।
রিয়াদ হাসতে হাসতেই বললেন, ‘অনেকেই বলেন আমি কুকুর নিয়ে পাগলামি করছি। তবে কিছু করার নেই। এগুলোকে এখন আর কুকুর বলে মনে হয় না। এগুলো আমার সন্তানের মতো। কুকুরগুলোকে আমি বাচ্চা বলেই ডাকি।’
কথা বলতে বলতেই রিয়াদ মাহমুদের ফোনে একটি কল আসে। গাজীপুরের একজন কয়েক দিন আগেই কুকুরের বাচ্চা কিনেছেন। জানালেন, জঙ্গলের কাছে তিনি থাকেন। কাছাকাছি র্যাবের ক্যাম্প, র্যাবের প্রশিক্ষণের সময় আওয়াজে কুকুরের বাচ্চা ভয় পায়। রিয়াদ মাহমুদ পরামর্শ দিলেন গান বাজানোর জন্য, যাতে প্রশিক্ষণের আওয়াজ কুকুরছানার কানে না যায়।
শাওনস কেনেল থেকে বাচ্চা কিনে নেওয়ার সময়ই ক্রেতাদের নিয়ম–কানুন শিখিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও যেকোনো সমস্যা জানাতে বলা হয়। এই কুকুরগুলো জন্মগতভাবেই হিংস্র, ক্ষিপ্র আর আত্মবিশ্বাসী হয়।
জার্মান শেফার্ডের কামড়ের জোর ২২৮ পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে বল প্রয়োগ)। ইতালিয়ান ম্যাসটিফের দাঁত বসানোর শক্তি ৭০০ পিএসআই, যা সিংহের চেয়ে বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই কুকুরগুলো বন্য প্রাণী দেখে খামারের পশু রক্ষায় ব্যবহার হয়।
‘রুটিন’ ধরে চলা
রিয়াদ মাহমুদ, লুবনা ইয়াসমীন আর ইল্লিন মাহমুদের সময় কাটে কুকুরগুলোর সঙ্গে। বাসায় কয়েকটি বিড়ালও আছে। লুবনা ইয়াসমীনের দায়িত্ব কুকুরগুলোর জন্য রান্না করে তা বাটিতে তুলে দেওয়া। ইল্লিন খাওয়ানো থেকে শুরু করে অন্য কাজগুলো সারেন। কুকুরের খাবারের পরিমাণ, পুষ্টি সব ঠিক রাখতে হয়। গমের রুটি, মাংস, সবজি, ফল, চিড়া, দুধ, কলা, মুরগির পায়ের স্যুপ, টোস্ট বিস্কুটসহ নানান খাবার দিতে হয়। দুপুরে আর রাতের মেনুতে থাকে খিচুড়ি।
ইয়াসমীন বললেন, অনেকগুলো কুকুরের রান্নাসহ দিনের বেশির ভাগ সময়ই চলে যায় কুকুরের তদারকিতে। ফলে নিজেদের পারিবারিক জীবনে কিছুটা প্রভাব তো ফেলেই। তবে এই কুকুরগুলোকে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন।
বাবার সঙ্গে ব্যবসার হাল ধরতে গিয়ে পড়াশোনায় বিরতি দিয়েছেন ইল্লিন মাহমুদ। তিনি জানালেন, সেই অর্থে তাঁর বন্ধুবান্ধব নেই বা থাকলেও যাঁরা পশু প্রাণী ভালোবাসেন, বন্ধুত্ব শুধু তাঁদের সঙ্গেই।
রিয়াদের দায়িত্ব ক্রেতা সামলানো, অসুস্থ কুকুরের যত্নআত্তিসহ বাকি সব। এ ধরনের ব্যবসার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসাটি লাভজনক। তবে পরিবারের সদস্যদের সহায়তা না পেলে এ ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। মানুষের মধ্যে কুকুর নিয়ে নেতিবাচক নানা ভাবনা আছে। অনেকে ভাবেন, তিনি যেহেতু কুকুর পছন্দ করেন না, তাই অন্য কেউ এটা নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন না। ঝামেলা বাধানোর চেষ্টাও করেন অনেকে। আর কুকুর যাতে ভালো থাকে তার জন্য খাবার, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার দিকে সব সময় নজর রাখতে হয়। কর্মী রেখে এসব কাজ করানো সম্ভব হয় না।
অনেকে খারাপ উদ্দেশ্যে কুকুরছানা কিনতে চান জানিয়ে রিয়াদ বলেন, যেমন প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করার জন্য বা অন্যকে ভয় দেখানোর জন্য কুকুরের বাচ্চা কিনতে চান। সেসব ক্রেতার কাছে বাচ্চা বিক্রি করা হয় না।
এই ব্যবসায় লাভ কেমন—জানতে চাইলে রিয়াদ মাহমুদ বললেন, বছরে ৫০ লাখ টাকা আয় হলে সব খরচ বাদ দিয়ে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা হাতে থাকে। এ টাকা দিয়েই ব্যবসাটা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। শুধু দেশে নয়, ব্যবসাটা আন্তর্জাতিক অর্থাৎ অন্যান্য দেশেও কুকুরের বাচ্চা বিক্রির লক্ষ্য রয়েছে তাঁর।