সজারুর মতো দেখতে প্রাণীটির নাম হেজহগ
সজারুর মতো দেখতে প্রাণীটির নাম হেজহগ

দিনব্যাপী আয়োজন

প্রাণী ও প্রাণের এক মেলা

শখের বশে সাপ পুষতেন নুর মো. জামিনুল ইসলাম। বিয়ের পর কবুতর পালার আবদার করেন তাঁর স্ত্রী ফারজানা হাসান। এক ছাদের নিচে ভিন্ন ভিন্ন খাঁচায় সাপ ও কবুতর দুটোই পুষতেন এই দম্পতি। তাঁদের প্রথম সন্তান কাফি আহমেদ অবশ্য সাপ বা কবুতর—কোনো দিকেই যায়নি। তার পছন্দ বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখি। কাফির বয়স যখন পাঁচ বছর, একদিন তার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে একটি বিদেশি প্রজাতির পাখি ঢুকে পড়ে। পাখিটিকে পুষতে শুরু করে ছোট্ট কাফি। সেই থেকে শুরু। ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ১৫ বছর বয়সী কাফির সংগ্রহে এখন মোট ১০টি ভিন্ন জাতের বিদেশি পাখি আছে। ছোটবেলা থেকেই প্রাণীপ্রেমী হিসেবে বড় হচ্ছে নিপুণ-ফারজানা দম্পতির ছোট সন্তান ৯ বছর বয়সী আলিয়া। তার পোষ্য ছোট্ট দুটি হ্যাম্পস্টার (ইঁদুরজাতীয় প্রাণী)। পরিবারটির সংগ্রহে আছে দুটি হেজহগ (সজারুর মতো দেখতে প্রাণী) এবং একটি সুগার গ্লাইডার (কাঠবিড়ালিজাতীয় প্রাণী)।

গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত প্রাণী-প্রাণের মেলায় গিয়ে কথা হয় হাস্যোজ্জ্বল এই পরিবারটির সঙ্গে। দিনব্যাপী মেলাটির আয়োজন করে বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ সমিতি।

স্ত্রী, দুই সন্তান এবং তাঁদের প্রিয় পোষ্যদের নিয়ে মেলায় এসেছেন জামিনুল ইসলাম। প্রায় তিন যুগের বেশি সময় ধরে বাড়িতে নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন প্রাণী পুষছেন তিনি। জামিনুল জানান, একটি-দুটি করতে করতে এখন পোষ্যের সংখ্যা ২৪টি। একসময় সংগ্রহে বিদেশি জাতের সাপ ছিল। এখন বিরল প্রজাতির কয়েকটি রাক্ষুসে মাছ, বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপের একটি জাত, বিরল প্রজাতির হাঁস এবং বিদেশি কুকুর আছে।

দিনব্যাপী মেলার সকাল থেকেই আসতে শুরু করেন প্রাণীপ্রেমীরা। সারি সারি সাজানো তাঁবুগুলোতে ভিড় করছেন তাঁরা। কোনোটিতে বিড়াল, কোনোটিতে কুকুর আর কোনোটিতে পাখি। বাইরে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েক জাতের ঘোড়া, আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি জাতের বিশালাকার কুকুর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিজের পালা পোষ্যদের নিয়ে এসেছেন পশুপ্রেমীরা। পোষ্যদের পরিচয় করে দিচ্ছেন আগ্রহী অতিথিদের সঙ্গে।

প্রায় ৭ ফুট উচ্চতার দুটি ঘোড়া নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে মেলায় এসেছেন বিক্রম। ঘোড়াগুলোকে শাবক অবস্থায় ভারতের রাজস্থান থেকে এনেছিলেন। পেলে-পুষে বড় করেছেন নিজেই। বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতায় দৌড়ায় ঘোড়াগুলো। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার যেমন, ঘাস, গম, বার্লি, ভুট্টা খায় ঘোড়াগুলো—জানালেন বিক্রম।

শখের বশে বাজিগর পাখি পালতে গিয়ে ফরপাস পাখির খোঁজ পান ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আমিরুজ্জামান। পকেটে পুরে রাখার মতো ছোট্ট জাতের টিয়া পাখিটির আরেকটি আদুরে নাম ‘পকেট প্যারট’। নানা রঙের সংমিশ্রণ দেখা যায় পাখিটিতে। প্রতিটি পাখিই অন্যরকম। তাই কেউ মিউটেশন করিয়ে একেবারেই অন্য রকম পাখি পেতে চাইলে ফরপাসের তুলনা নেই, জানালেন আমিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ফরপাস পাখির মিশ্র মিউটেশনের খেলা শেষ হওয়ার না। আকারে ছোট বলে পালতে জায়গা লাগে কম। জোড়াপ্রতি দাম ৮ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা হতে পারে।

দুই মাস বয়সী একটি রঙিন ম্যাকাউ পাখি নিয়ে এসেছেন তাহসিন রহমান। সুদূর ব্রাজিল থেকে সংগ্রহ করেছেন পাখিটি। তাঁর সংগ্রহে দেখা গেল, ছাই রঙের পালকে ঢাকা টুকটুকে লাল রঙের লেজের আফ্রিকান গ্রে প্যারোট, সবুজ শরীর আর কমলা লেজের অ্যামাজন ওরেঞ্জ উইং প্যারোট এবং আকাশি রঙের একটি টিয়া পাখির নাম ভারতীয় রিংরেট। তাহসিন জানান, ছোটবেলা থেকেই পাখি পোষেন তিনি। ২০০৮ সালে ‘হবি অ্যান্ড ন্যাচার’ নামে নিজের একটি সংগঠনও তৈরি করেন তিনি।

পুরো প্রদর্শনীর একমাত্র বিড়ালের দেখা মিললো প্রথম দিকের একটি তাঁবুতে। কুচকুচে কালো বিড়ালটির চোখের রং টিয়া পাখির পালকের মতো সবুজ। নাম টুথলেস। বিড়ালটির দত্তক মা সোমা সিদ্দিকি জানান, বিড়াল দেশি এবং ব্রিটিশ শর্ট হেয়ার দুই জাতের সংমিশ্রণ। স্বভাবও ভীষণ ঠান্ডা। বিড়াল পালাকে অতিরিক্ত কোনো ঝামেলা মনে করেন না সোমা। তিনি বলেন, বছরে একবার ভ্যাকসিন দিতে হয়। কয়েক মাস পর পর ডিওয়ার্মিং করাই। এ ছাড়া বিড়ালের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার কমিয়ে দিতে হয়।

মেলায় বিদেশি জাতের কুকুরের মধ্যে ছিল জার্মান শেফার্ড, কিং শেফার্ড ও ডোবারম্যান। প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পছন্দের কোরগি জাতের দুটি কুকুর দেখা গেল একটি তাঁবুতে। ছিল একটি প্রাণীবাহী অ্যাম্বুলেন্স।

মেলায় ঘুরে ঘুরে আগত প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন হিউমেন পউস ইনিশিয়েটিভের প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক ভেট বেন ইয়া আমিন। বন্য প্রাণী রক্ষায় কর্মরত তরুণ এই চিকিৎসক বলেন, ‘পৃথিবীর ওপর মানুষের যতটুকু অধিকার আছে, প্রতিটি প্রাণীরও সমান অধিকার আছে। মানুষের বোধ আছে, সেবা দেওয়া, রক্ষা করার ক্ষমতা আছে, তাই মানুষকে প্রাণীর প্রতি আরও সদয় হতে হবে। প্রাণী পোষার পাশাপাশি প্রাণী রক্ষায় কাজ করতে হবে। বন উজাড় এবং শিকার বন্ধ করতে হবে। যার যার জায়গা থেকে পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে হবে। কেননা জীববৈচিত্র্যের ওপর আমাদের সবার অস্তিত্ব নির্ভর করে।’