কাজীপাড়ার পাহাড়ি রেস্তোরাঁর সিএইচটি কালিনারিতে পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে ভিড় করেছেন ভোজনরসিকরা
কাজীপাড়ার পাহাড়ি রেস্তোরাঁর সিএইচটি কালিনারিতে পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে ভিড় করেছেন ভোজনরসিকরা

আমার ঢাকা

মেজবান, চুই গোস্ত, ব্যাম্বু চিকেন ঢাকাতেই পাবেন

ঢাকায় খাদ্য-বাণিজ্যের অনেকটাই এখন ফাস্ট ফুড বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে। রমরমা ব্যবসা। পাড়ার মোড় থেকে কানাগলি, এমনকি বড় রাস্তার মোড়—সবখানেই সহজপ্রাপ্য বার্গার, সসেজ, হটডগ, স্যান্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। গত দুই দশকে মূলত ইন্টারনেটের কল্যাণে আর জেন-জিদের মজে যাওয়ায় ঢাকার অলিগলিতে ফাস্ট ফুডের এত ছড়াছড়ি। ফাস্ট ফুড ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতির খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে।

তবে এর মধ্যেও রয়েছে ব্যতিক্রম। একদল স্বপ্নসারথি ঢাকায় দেশের বৈচিত্র্যময় খাদ্যসম্ভারকে ধরে রেখেছেন। কেউ বিক্রি করছেন খুলনার চুইঝাল, কেউ চট্টগ্রামের মেজবানের মাংস, রাজশাহীর কলাই রুটিও বিক্রি হচ্ছে এই ঢাকাতেই। পার্বত্য এলাকার বৈচিত্র্যময় খাদ্যসম্ভার নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশেষায়িত ‘ফুড হাভ’। তাই ঢাকায় বসে ছুটির দিনে দেশের বৈচিত্র্যময় খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।

ফুড হাভ: কাজীপাড়া

মিরপুরের কাজীপাড়া একটি ঘিঞ্জি এলাকা। পানীয় জলের সমস্যা প্রকট এখানে। রয়েছে মশার উৎপাত। কিন্তু কাজীপাড়ার আরেকটি পরিচয় আছে। সেটি হচ্ছে, কাজীপাড়ায় দেশের প্রায় সব অঞ্চলের সবজি ও মাছ টাটকা পাওয়া যায়। আপনার যদি প্রাতর্ভ্রমণের অভ্যাস থাকে, তাহলে ফ্রিজে রাখা ছাড়াই প্রতিদিনের সবজি প্রতিদিনের পাতে পাবেন মধ্য ঢাকার এই পাড়ায়।

মানিকগঞ্জের লাউ থেকে মুন্সিগঞ্জের আলু, লালমনিরহাটের সাপ্টিবাড়ির বেগুন থেকে শেরপুরের দই—সবই পাওয়া যায় কাজীপাড়ায়। আর পাহাড়ি অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় সবজিসম্ভার—হলুদ ফুল, শিমের বিচি, রোজেলাপাতা, শিমুলের শুঁটকি, মুলা শুঁটকি, শুস মরিচ, মাশরুম প্রতিদিনই মিলছে ঘিঞ্জি পাড়াটির অলিগলিতে।

পাহাড়ি সবজিকে কেন্দ্র করে এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে একাধিক পাহাড়ি ক্যাফে-রেস্তোরাঁ। রোজ সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ে গরম-গরম বিক্রি হচ্ছে পাহাড়ি মুংডি (একধরনের নুডলস)।

সিএইচটি আট পদের এই প্লাটার খেতে পারবেন পাঁচজন। খরচ পড়বে ২,২৩০ টাকা

সিএইচটিতে মায়ের পদ

কাজীপাড়ার তিনটি পাহাড়ি রেস্তোরাঁর একটি সিএইচটি কালিনারি। ঢাকার দুই প্রান্ত উত্তরা কিংবা মতিঝিল থেকে রেস্তোরাঁটিতে পৌঁছাতে হলে আপনাকে কাজীপাড়া মেট্রোস্টেশনের পূর্ব পাশে নামতে হবে। এরপর একটু হেঁটে পৌঁছাতে হবে মেট্রোর ২৮২ নম্বর পিলার বরাবর। অতঃপর বাগানবিলাসের রাস্তা ধরে কয়েক কদম হাঁটুন, হাতের বাঁয়ে পড়বে সিএইচটি কালিনারি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সব পদের জনপ্রিয় খাবার পাওয়া যায় এখানে। রোজেলাপাতা দিয়ে ঝোল ঝোল মুরগি (হুরো আমিলে জুস) থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি পদ—বেগুন গাভি, রোজেলা কারি, আদা ফুল, হলুদ ফুল আর বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি ভর্তা-শুঁটকি গরম-গরম পাবেন রেস্তোরাঁটিতে।

টিপটপ স্নিগ্ধ খাবারঘরটি গড়ে ওঠার একটি ছোট গল্প আছে। আড্ডাচ্ছলে সে কথাই বলছিলেন সিএইচটি কালিনারির বর্তমান মালিক জুম্মান চাকমা। তিনি বলেন, ‘মূলত চাকরির খোঁজে গত করোনার আগে আগে ঢাকায় আসি। চাকরি মিলছে না। এর মধ্যে একদিন গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। ভয় পেয়ে গেলাম। নিঃসঙ্গ দুপুরে মাকে খুব মনে পড়ল। আর মনে পড়ল, জ্বর হলে মা রোজেলা–চা করতেন। ভাতের সঙ্গে তরকারি থাকত রোজেলা মুরগি কারি। শরীরে একটা খুব বল আসত। জ্বর এমনিতেই সেরে যেত। এরপর যত দিন গেছে, ঢাকার একঘেয়ে খাদ্যাভ্যাসে বিরক্ত হয়েছি। আর মায়ের বিশেষ বিশেষ পদগুলো খুব মিস করেছি। বলতে পারেন, মায়ের মমতামাখানো পদগুলোই আমি প্রতিদিন সিএইচটি কালিনারিতে রাঁধতে চাই। পাহাড়-পর্বত-সমতলের মানুষকে বীর চট্টলার বৈচিত্র্যময় খাদ্যের স্বাদ পাতে তুলে দিতে চাই।’

সিএইচটি কালিনারিতে ষড়্‌ঋতু ধরে খাবারের পদ রান্না হয়। যেমন এখন বর্ষাকাল। পাহাড়ে কচি বাঁশকোঁড়ল সহজলভ্য। হলুদ ফুলে ফুলে পাহাড় ছেয়ে গেছে। এখন রেস্তোরাঁটিতে গেলে পাবেন হলুদ ফুলের মাছভর্তা। কচি বাঁশকোঁড়লের বিভিন্ন পদ। এ ছাড়া নিয়মিতভাবে ব্যাম্বু চিকেন, পাজন, সবজির তোজা, শুঁটকি হেবাং, বিলাতি আলু দিয়ে পাহাড়ি মুরগি, শুঁটকি, পাহাড়ি শাক, মাছ ও ভর্তা গরম-গরম পরিবেশন করা হয়। দুজন মিলে, বন্ধুবান্ধব-পরিবারসহ রেস্তোরাঁটিতে যেতে পারেন। খাবারের স্বাদের পাশাপাশি রেস্তোরাঁর শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ আপনাকে অন্য রকম আবেশে জড়াবে।

যোগাযোগ: ফেসবুক পেইজ

মুঠোফোন: ০১৭৭৭-১৯৯১১৩

ঝাল ঝাল কাঁকড়া ভুনাতে ব্যবহৃত হয় পাহাড়ি ধনে

জুম রেস্তোরাঁ হেবাং

হেবাং চাকমা শব্দ। পার্বত্য অঞ্চলে জুমে উৎপাদিত সবজি ভাপে রান্নার চল আছে। কলাপাতা কিংবা বাঁশের চোঙে সবজির পাশপাশি বিশেষ কৌশলে মাছ, মাংস, শুঁটকি—পাহাড়ি সব পদই রান্না করা হয় রেস্তোরাঁটিতে। হেবাং নারী পরিচালিত প্রথম পাহাড়ি খাবারের রেস্তোরাঁ। চার বোন রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করছেন। ২০১৬ সালে চালু হওয়া রেস্তোরাঁটি পাহাড়ি খাবারের দোকান হিসেবে ভোজনরসিকদের মধ্যে বেশ পরিচিত।

হেবাংয়ের খাবারের তালিকায় আছে ‘হরবো’ ও ‘গুদেয়ী’ নামে ভর্তার পদ। আছে ভাপে রান্না। গরু, মুরগি, শুঁটকি, কবুতর, মাছ, সবজি, ডিম—নানা কিছু রান্না হয় এখানে। চালের গুঁড়া মেশানো ঝোল ঝোল ‘মুরগি হড়োই’ রেস্তোরাঁটির সিগনেচার আইটেম। বাঁশের চোঙে রান্না করা বিভিন্ন ধরনের মাংসের ঐতিহ্যবাহী পদগুলো তো আছেই। আর আছে নানা ধরনের ভর্তা। এ ছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন সবজি, যেমন বাঁশের কোঁড়, হলুদ ফুল, আদা ফুল, পাহাড়ি শিম, জুমের কুমড়া-শসার নানা পদও মৌসুম অনুযায়ী হেবাংয়ে পাওয়া যায়।

যোগাযোগ: ফেসবুক পেইজ

মুঠোফোন: ০১৭০১-৬১৭৮২০

চুইঝাল মিলছে ঢাকায়

চুই মূলত একটি মসলা। সুপারিগাছে মূলত পরগাছা হিসেবে চুইয়ের চাষ করা হয়। খুলনা-যশোর অঞ্চলের মানুষদের খাবারের পাতে চুই মসলা অতি আদরণীয়। বৃহত্তর খুলনা ও যশোরের প্রায় সব জেলায় চুই দিয়ে মাংস রান্নার চল আছে। চুই মসলার বিশেষত্ব হলো এর ঝাল স্বাদ। ঝালটা প্রথম তীব্র মনে হবে। খানিক পরেই মাংসের সঙ্গে চুইয়ের বিশেষ রসায়ন আপনাকে স্বস্তি দেবে। বিশেষ করে চুইয়ের সঙ্গে খাসির মাংসের যুগলবন্দী রসনাবিলাসকে বিশেষ মাত্রা দেয়। ঢাকায় চুইঝাল রেস্তোরাঁর সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ‘সিরাজ চুই গোস্ত’। শহরজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির নয়টি শাখা রয়েছে। ধানমন্ডি, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, গাবতলী, বনানী, বনশ্রী, উত্তরা, খিলগাঁও ও বসুন্ধরায় সিরাজের রেস্তোরাঁয় আপনি চাইলেই চুইঝাল মাংসের স্বাদ নিতে পারবেন।

যোগাযোগ: https://www.shirajchuigosto.com/

চট্টগ্রামের মেজবানি

মেজবান ফারসি শব্দ। মূলত অতিথি আপ্যায়নকারীকে মেজবান বলা হয়। আর মেজবানি হচ্ছে আতিথেয়তা, মেহমানদারি অথবা অতিথিদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা। মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেজবান শব্দটি গণভোজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। প্রিয়জনদের মৃত্যু বা মৃত্যুদিবস, জন্ম বা জন্মদিবস, নিজেদের কোনো সাফল্য, নতুন কোনো ব্যবসা শুরু, নতুন বাড়িতে প্রবেশ কিংবা নবজাতকের নাম রাখা উপলক্ষে মেজবানির আয়োজন করা হয়। তাই চট্টগ্রামের মানুষের কাছে মেজবান শুধু এক বেলার খাবার নয়; এটি একটি বিশেষ সামাজিক সংস্কৃতি। মেজবানি রান্নায় গরুর বিভিন্ন অংশের মাংস প্রয়োজন হয়। রান্নাটি অবশ্যই করতে হবে শর্ষের তেলে। মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয় হাটহাজারীর বিশেষ মসলা। মেজবানের মাংস রান্নায় কোনো শর্টকাট নেই। ধীরে ধীরে, ধোঁয়া ওঠা মাটির চুলায় কাঠের আগুনে রান্না করতে হয় মেজবানির মাংস।

মেজবানিকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ। এর মধ্যে ‘নওয়াব চাটগাঁও’ অন্যতম। রেস্তোরাঁটি গুলশান-১ নম্বরে অবস্থিত। এ ছাড়া ধানমন্ডির দাওয়াত-এ-মেজবান, বারিধারার মেজবান বাড়ি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনে হোটেল জামান অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউস চট্টগ্রামের মেজবানির জন্য বিখ্যাত। এসব রেস্তোরাঁয় পাচক ও মসলা আনা হয় চট্টগ্রাম থেকে।

যোগাযোগ:

• নওয়াব চাটগাঁও: nawabchatga@gmail.com, ০১৮৭৩৬৬৭৭৬৬

• দাওয়াত-এ-মেজবান: ফেসবুক পেইজ, ০১৮৪১৬৫৩০৫৯

• মেজবান বাড়ি: ফেসবুক পেইজ , ০১৯১১০৮৮৮০৮

চাঁপাইয়ের কলাই রুটি

কলাই রুটি সাধারণ রুটির চেয়ে আকারে বড় ও মোটা। এই রুটি বানানোর জন্য লবণ ও পানির পাশাপাশি মাষকলাইয়ের আটা এবং পরিমিত মাত্রায় চালের আটা ব্যবহার করে খামির তৈরি করতে হয়। সাধারণ রুটির মতো এই রুটি বানাতে বেলন-পিঁড়ির প্রয়োজন হয় না। তার বদলে হাতের তালু ভিজিয়ে খামিরকে রুটির আকার দিতে হয়। এরপর সেগুলোকে একটি মাটির পাত্রের ভেতর নিয়ে চুলায় বসিয়ে কলাই রুটি তৈরি হয়।

মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের কাছে কলাই রুটি বিশেষ খাবার। সাধারণত পোড়া বেগুন, রসুনের ভর্তা বা ঝাল মাংসের সঙ্গে কলাই রুটি খাওয়া হয়।

খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকার নুরবাগ জামে মসজিদের পাশে ‘কলাই রুটির আড্ডা’ নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু রেখেছেন রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শহরে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি কলাই রুটি রেস্তোরাঁ যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু খাবারটি আঞ্চলিক হওয়ায় ব্যবসায়িকভাবে তেমন কেউ সফল হতে পারেননি। অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়েছে। আমি ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’

‘কলাই রুটির আড্ডা’য় রুটির সঙ্গে বেগুনভর্তা, লবণ-ঝালভর্তা, ধনেপাতাভর্তা, রসুনভর্তা, টক ঝালভর্তা, আচার, শুঁটকিভর্তা ও আলুভর্তা পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া হাঁসের মাংস, গরুর ভুনা, বট, চিকেন ভুনাও পাওয়া যায় রেস্তোরাঁটিতে।

যোগাযোগ: www.kalairutiradda@gmail.com

মুঠোফোন: ০১৮৮৬৯০৫৭৩৬