ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি

অলিগলিও ভাঙাচোরা, হাঁটাই দায়

ছোট–বড় অসংখ্য গর্তে পানি জমে একেক জায়গা যেন ডোবায় পরিণত হয়েছে। যানবাহনগুলো গর্ত এড়িয়ে চলছে। অনেক সড়কের চিত্রই এখন এমন।

রাজধানীর গুলশান ও বাড্ডার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকপাড়ের ‘গুলশান লেক ড্রাইভ’ সড়কটি এখন চলাচলের অনুপযোগী। বাড্ডার হাতিরঝিল মোড় থেকে বারিধারা পর্যন্ত ২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ২০১৮ সালের নভেম্বরে উদ্বোধন করা হয়। এরপর আর কোনো সংস্কার হয়নি।

গুলশান অ্যাভিনিউতে যানবাহনের চাপ কমানো এবং বাড্ডা, শাহজাদপুর ও বারিধারার মধ্যে বিকল্প যোগাযোগ নিশ্চিত করতেই নির্মাণ করা হয়েছিল সড়কটি। কিন্তু এখন সড়কটিতে হাঁটাও দায়। সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচ উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরে গেছে। গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে গভীরতা বোঝার উপায় নেই। এতে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে, হেলেদুলে, ঝুঁকি নিয়ে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুই-তিন বছর ধরেই রাস্তা এমন বেহাল। বর্ষা মৌসুমে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। এখন অনেকেই বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন।

সড়কটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৩-এর আওতাধীন। করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, সড়কটি আগে রাজউকের মালিকানায় ছিল। গত বছরের নভেম্বরে এটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আলম জানান, সড়ক সংস্কারে প্রায় ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্ষা শেষে কাজ শুরু হবে এবং মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।

গুলশান লেক ড্রাইভ রোডের মতো রাজধানীর উত্তর সিটির আরও অনেক রাস্তা বেহাল। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাস্তাগুলোর অবস্থাও খারাপ। সময়মতো সংস্কারকাজ না হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিশেষ করে অলিগলির রাস্তাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার যেন কেউ নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অনেক সড়ক এমন ভাঙাচোরা ও গর্তে ভরা। গত বুধবার দুপুরে গুলশান লেক ড্রাইভ রোডে

উত্তর সিটির ভাঙাচোরা রাস্তা

গত মঙ্গল ও বুধবার প্রথম আলোর প্রতিবেদক ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল ২, ৩, ৪, ৫ ও ৯-এর আওতাধীন বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখেছেন। মিরপুরের রূপনগর, শাহ আলীবাগ, সেনপাড়া পর্বতা, কাফরুল, পূর্ব বাইশটেকি, বাড্ডার গোপীপাড়া, সাতারকুল, মহাখালী দক্ষিণপাড়া, মধুবাগ, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া—এসব এলাকায় অলিগলির বহু রাস্তা ভেঙে গেছে। কোথাও ঢালাই ভেঙে লোহার রড বেরিয়ে আছে, কোথাও ভেঙে সৃষ্ট গর্তে পানি জমে চলাচলে ঝুঁকি তৈরি করেছে।

মিরপুরের সেনপাড়া-পর্বতা এলাকায় একটি গার্মেন্টসের সামনের রাস্তা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। রিকশায় ওঠা যাত্রীদের বসে থাকাই দায়। সেখানকার বাসিন্দা সানাউল ইসলাম বলেন, শুকনা মৌসুমে ধুলা, বর্ষায় কাদা—সব সময় দুর্ভোগ। এ রাস্তায় এখন হেঁটে চলতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

ভাটারা মাদানি অ্যাভিনিউতেও একই অবস্থা। ছোট-বড় অসংখ্য গর্তে পানি জমে একেক জায়গা যেন ডোবায় পরিণত হয়েছে। যানবাহনগুলো গর্ত এড়িয়ে চলছে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।

বেগম রোকেয়া সরণি, মিরপুর রোড, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণি, প্রগতি সরণি—এসব সড়ক তুলনামূলক ভালো। কিছু জায়গায় কার্পেটিং উঠে গিয়ে ছোট ছোট ভাঙনের চিহ্ন স্পষ্ট। কোথাও সড়ক দেবে গিয়ে তৈরি হয়েছে উঁচু-নিচু পথ।

বর্ষাতেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি

বর্ষার মধ্যেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি। রূপনগর, জনতা হাউজিং, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া পর্বতা, বাইশটেকি ও মহাখালী দক্ষিণপাড়ায় সরেজমিনে সড়ক খুঁড়ে ড্রেন বসানোর কাজ চলতে দেখা গেছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল, ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। খনন শেষে নালার উপরিভাগের মাটি ফেলে সমান না করায় কাদা-পানি জমে দুর্দশা আরও বেড়েছে।

রূপনগরের আরিফাবাদ আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার মাঝবরাবর খুঁড়ে পানিনিষ্কাশনের নালা বসানো হয়েছে। ফলে যান চলাচল বন্ধ। নালার পাইপ বসানোর পর ওপরের মাটি এখনো সমান করা হয়নি। রাস্তার এক পাশে রাখা হয়েছে খুঁড়ে রাখা মাটি ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী। এতে এক পাশ দিয়ে কোনোমতে আবাসিক এলাকার ভেতরে যাচ্ছেন বাসিন্দারা।

২৫% রাস্তার সংস্কার প্রয়োজন

ঢাকা উত্তর সিটিতে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ১৯০ কিলোমিটার, সংযোগ সড়ক ৩৪৫ কিলোমিটার, আর অলিগলি ৮০৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে নতুন যুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডসহ প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার সড়ক এখনই সংস্কারের প্রয়োজন, যা মোট সড়কের প্রায় ২৫ শতাংশ।

ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৬১ কিলোমিটার সড়ক, ৫২ কিলোমিটার নালা ও ১৬ কিলোমিটার ফুটপাত উন্নয়ন করা হয়েছে, যার জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা। বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় আরও প্রায় ৩৯ কিলোমিটার রাস্তা ও ৪৮ কিলোমিটার নালার কাজ হয়েছে, এতে ব্যয় হয়েছে ৩৩৮ কোটি টাকা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ বলেন, চলতি অর্থবছর উন্নয়ন খাতে সড়ক, নালা ও ফুটপাত নির্মাণে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৬৯০ কোটি টাকা। বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য রাখা হয়েছে ৯৯০ কোটি টাকা। এর আওতায় রাস্তা, ফুটপাত ও নর্দমার কাজ চলবে।

দক্ষিণ সিটিতে বেহাল সড়ক

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ অলিগলির সড়ক ভাঙাচোরা। কিছু কিছু এলাকার মূল সড়কই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আট মাস ধরে খিলগাঁও এলাকার বাসাবো-মাদারটেক সড়কটির অবস্থা বেশি খারাপ। এই বেহাল সড়কের বর্ণনা করতে গিয়ে খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটির এক প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই রাস্তা দিয়ে আর চলাচলই করি না। অবস্থা এতটাই খারাপ যে যানবাহনে বসে থাকা দায়। এখন বিকল্প পথ দিয়ে চলাচল করি।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে সব মিলিয়ে ১০০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে। পর্যায়ক্রমে তাঁরা এসব সড়কের উন্নয়নকাজ করে সচল করবেন।

গত মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সায়েদাবাদ থেকে খিলগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার পথে খিলগাঁও উড়ালসড়কের মুখ থেকে শুরু করে নন্দীপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত সড়কটি (এটি বাসাবো-মাদারটেক সড়ক নামে পরিচিত) খানাখন্দে ভরা। কোথাও বড় বড় গর্ত। যেসব স্থানে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, সেসব স্থানে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তা ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে দিনভর এই পথে যানজট লেগেই থাকে।

এই সড়কের পাশের এলাকার বাসিন্দা এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খিলগাঁও উড়ালসড়কের গোড়া থেকে নন্দীপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক তাঁদের স্বাভাবিক চলাচল থমকে দিয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ হলেও কর্তৃপক্ষ সড়ক সংস্কারের ব্যাপারে উদাসীন।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সময়েই এই সড়ক সংস্কারের ঠিকাদার চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তখন সড়কটি ৬০ ফুট প্রশস্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩০ কোটি টাকা। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আগের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে সড়ক প্রশস্ত করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে উন্নয়নকাজের সিদ্ধান্ত হয়। পরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির ঈদের আগেই পুরোদমে কাজ শুরুর পরিকল্পনা ছিল। পরে কোরবানিতে মানুষের ভোগান্তি বিবেচনায় কাজ ঈদের পর শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় কাজ শুরু হলেও গতি খুব একটা নেই। কার্যাদেশে আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে সড়কটির সংস্কারকাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।

পরে খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, ধানমন্ডি, আজিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকার অলিগলির সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সেসব সড়কে পলেস্তারা উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ম্যানহোলের ঢাকনা নেই। সেখানে লাঠি ও কাপড় বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে।

এদিকে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সিটি করপোরেশনে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনসহ নানা কারণে সংস্থাটির সব ধরনের উন্নয়নকাজই অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রাস্তাঘাট বেহাল মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে ফেলছে।

খিলগাঁও এলাকার বেহাল সড়কের বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সেসব সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হবে। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হবে বলে জানান এই প্রকৌশলী।