প্রযুক্তির এই যুগে রিকশায় পরিবর্তন এসেছে। রিকশাচিত্র এখন আর রিকশায় বসে না। অন্য মাধ্যমে রিকশাচিত্রকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন শিল্পীরা। শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসেন এখনো আঁকেন রিকশাচিত্র। সম্প্রতি রাজধানীর হোসেনি দালান এলাকায়
প্রযুক্তির এই যুগে রিকশায় পরিবর্তন এসেছে। রিকশাচিত্র এখন আর রিকশায় বসে না। অন্য মাধ্যমে রিকশাচিত্রকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন শিল্পীরা। শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসেন এখনো আঁকেন রিকশাচিত্র। সম্প্রতি রাজধানীর হোসেনি দালান এলাকায়

রিকশাচিত্রের শেষ অধ্যায়

গলির মোড়ে হারিয়ে যাওয়া রং

ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া রিকশাচিত্রের এখন আর কদর নেই। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়াতেই স্বমাধ্যমে স্থান হারিয়েছে এ শিল্প।

চওড়া তুলি আর গাঢ় রঙে লেখা ‘আল্লাহ ভরসা’, ‘মায়ের দোয়া’ অথবা ‘মনে রেখো’। আশপাশে লতাপাতায় ছাওয়া। চলমান রঙিন ছবিটা যেতে যেতে একসময় মিলিয়ে গেল গলির মোড়ে। তবু মনের অজান্তে লেগে রইল সে রং।

গদিতে কখনো খাইবার মেল–এর নায়িকা নীলো, কখনো বেদের মেয়ে জোছনার চেহারা। ডালনায় আঁকা হলুদ বাঘ আর বিড়ালের পার্থক্য ছিল সামান্যই। চেসিসের গায়ে আঁকা কল্পনার বোরাক উড়তে চাইছে আকাশে। নায়িকার মতো একই গোলাপি রঙের আভা নায়কের মুখেও। এসব শুধু ছবি নয়! সময় ও সমাজের প্রত্যাশা-পছন্দের প্রতীক হয়ে উঠে এসেছিল এই ভ্রাম্যমাণ আর্ট গ্যালারিতে। এই মাধ্যমে ধাপে ধাপে কখনো ঐতিহাসিক স্থাপনা, কখনো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক, কখনোবা গুরুত্ব পেয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের দৃশ্য।

অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা এ লোকশিল্পই বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ২০২৩ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর বৈশ্বিক বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। কিন্তু সেই শিল্প এখন টিকে আছে অন্য মাধ্যম নির্ভর হয়ে। রিকশায় নেই রিকশাচিত্র, বরং পাওয়া যাবে শৌখিন বস্তুতে। ঢাকা শহরেও এখন হাতে আঁকা রিকশা আর্টের চল নেই। শিল্পীরা খুঁজে নিয়েছেন বিকল্প পেশা। পাঁচ দশকের পুরোনো রিকশাচিত্রশিল্পীরা বলছেন, ডিজিটাল আর্ট, রিকশার জন্য ব্যয় হ্রাস, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়াতেই স্বমাধ্যমে স্থান হারিয়েছে এ শিল্প। গবেষকেরা বলছেন, এ বিষয়ে সরকারেরও সুনির্দিষ্ট কোনো ভাবনা না থাকাই বড় কারণ।

ছবি আঁকা যে হয় না, তা জানা গেল গত শতকের সত্তর ও আশির দশকের তুমুল ব্যস্ত রিকশাচিত্রশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে। এই মাধ্যমে সবচেয়ে প্রবীণ শিল্পীরা এখন ছবি আঁকেন ঘরের শৌখিন বস্তু টেবিল, চেয়ার, হারিকেন, কেটলি বা ট্রে, আয়না থেকে শুরু করে শাড়ি বা সানগ্লাসের জন্য।

ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি

এ দেশে পঞ্চাশের দশক থেকে রিকশাচিত্রশিল্পের এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলীনুর, দাউদ উস্তাদের মতো রিকশাচিত্রশিল্পীরা। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে এ দেশের রিকশাচিত্র, সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং ও ট্রাক আর্ট। লন্ডন, জাপান, নেপালে বাংলাদেশের রিকশা আর্ট নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। বাংলাদেশের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। যেখানে রিকশা ও বেবিট্যাক্সি–চিত্রশিল্পীদের ৫০০ শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছিল। কিন্তু এ শিল্পটি কখনো মূলধারার শিল্পীদের কাজের সঙ্গে মর্যাদা পায়নি।

১৯৬৭ সাল থেকে চলচ্চিত্রের ব্যানার ও পরবর্তী রিকশাচিত্রের কাজ করা শিল্পী হানিফ পাপ্পুও এখন প্রবীণ হয়েছেন। রাজধানীর হোসেনি দালান এলাকার বাসিন্দা এই শিল্পী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর আরও ক্ষতি হয়েছে। এটা এখন বড়লোকের শিল্প। একসময় সবাই মনে করত এটা হলো গরিব মানুষের আর্ট। স্বীকৃতির পর যখন রিকশা আর্টকে এত সম্মান দেওয়া হচ্ছে, তত দিনে রিকশা আর্ট চলে গেছে শখের জিনিসের গায়ে। ঢাকা শহরে এখন আর রিকশার জন্য ছবি আঁকা হয় না বললেই চলে।’ 

ছবি আঁকা যে হয় না, তা জানা গেল গত শতকের সত্তর ও আশির দশকের তুমুল ব্যস্ত রিকশাচিত্রশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে। এই মাধ্যমে সবচেয়ে প্রবীণ শিল্পীরা এখন ছবি আঁকেন ঘরের শৌখিন বস্তু টেবিল, চেয়ার, হারিকেন, কেটলি বা ট্রে, আয়না থেকে শুরু করে শাড়ি বা সানগ্লাসের জন্য। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে বাজারজাত করে। এই রিকশাচিত্রশিল্পীরা বলছেন, ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকে কম দামে ডিজিটাল প্রিন্টে রিকশাচিত্র শুরু হতেই গুরুত্ব হারিয়েছে হাতে আঁকা শিল্পটি।

বাংলাদেশের রিকশা আর্ট একটি মৌলিক শিল্প। এই আর্ট আর পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সন্দেহ নেই, ডিজিটাল প্রিন্টের সময় থেকেই শিল্পের মূল্য কমতে শুরু করে।
প্রবীণ শিল্পী এস এম সামসুল হক

সুলভে ডিজিটাল প্রিন্ট

স্বাধীনতা-উত্তরকালের রিকশাচিত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন শিল্পী মো. রফিকুল ইসলাম। বাংলাদেশ রিকশা আর্ট সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এই শিল্পী জানান, রিকশার জন্য তিনি সর্বশেষ ছবিটি এঁকেছেন ২০১৯ সালে। অনেক দিন ধরে তিনি এই মাধ্যম ব্যবহার করে ছবি আঁকেন শখের বস্তুর জন্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাতে আঁকা রিকশাচিত্র রোদ–ঝড়–বৃষ্টিতেও একই রকম থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে আঁকা ছবির দাম যখন ৩০০ টাকা তখন রিকশার জন্য হাতে আঁকা পুরো এক সেট ছবির দাম ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবেই রিকশার মালিকেরা এত টাকা খরচ করতে চান না।’

রিকশাশিল্পকে বাঁচাতে হলে আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা দরকার। সরকার যদি পুরান ঢাকায় শুধু পায়ে চালানো রিকশা যাতায়াতের অনুমতি দেয় এবং সেসব রিকশায় হাতে আঁকা ছবি থাকতে হবে এমন নিয়ম করে, তাহলে হয়তো কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব হবে।
শিল্পী সৈয়দ আহমদ হোসাইন

প্রবীণ শিল্পী এস এম সামসুল হক এ কাজ শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রিকশা আর্ট একটি মৌলিক শিল্প। এই আর্ট আর পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সন্দেহ নেই, ডিজিটাল প্রিন্টের সময় থেকেই শিল্পের মূল্য কমতে শুরু করে।’

শিল্পী সৈয়দ আহমেদ হোসেনের আঁকা কিছু রিকশাচিত্র

যেভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল

রিকশাচিত্রশিল্পীরা বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রিকশাচিত্র করা হতো চলচ্চিত্র তারকাদের মুখচ্ছবি অবলম্বনে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি রিকশায় মানুষের ছবি আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা হলে চর্চা বাড়ে পশুপাখির ছবি আঁকায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ছবি আঁকা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য গুরুত্ব পেয়েছে সব সময়। এ ছাড়া বিভিন্ন নকশার ফুল, পাখি ছিল রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তু। মুসলিম উপাখ্যানের দুলদুল, বোরাক কিংবা আরব্য রজনীর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, রাজকন্যা, রাজপ্রাসাদ স্থান করে নিয়েছে রিকশাচিত্রে। স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ইত্যাদি স্থাপত্যও বহুবার এ চিত্রের বিষয় হয়েছে। তাজমহল আর মৎস্যকন্যা ছিল আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়। 

 লন্ডন, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রশিল্প নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন গত শতকের ষাটের দশকের শিল্পী সৈয়দ আহমদ হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিকশাশিল্পকে বাঁচাতে হলে আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা দরকার। সরকার যদি পুরান ঢাকায় শুধু পায়ে চালানো রিকশা যাতায়াতের অনুমতি দেয় এবং সেসব রিকশায় হাতে আঁকা ছবি থাকতে হবে এমন নিয়ম করে, তাহলে হয়তো কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব হবে।’