মাকে কেন নতুন সাদা কাপড়ে মোড়ানো হলো, জানতে চায় ছোট্ট আইয়ান

ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াইয়ে হার মেনে বিদায় নিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা ফারজানা শারমিন
ছবি: সংগৃহীত

আইয়ান তিহানের বয়স চার বছর। মা ফারজানা শারমিনকে কবর দিতে দেখেছে। ও বুঝতে পারছে না, মা আর ফিরবেন না। তাই অন্যদের কাছে জানতে চাইছে, মা আবার কবর থেকে উঠে আসবেন কি না। আবার কখনো জানতে চাইছে, তার মাকে কেন নতুন সাদা কাপড়ে (কাফনের কাপড়) মোড়ানো হলো, তার মা তো বাসায় এমন কাপড় পরেন না।

আইয়ানের বোন ফাতিহা রিদ্বীনের বয়স ১১। সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে মা আর ফিরবেন না। তবে অভিমান করে বলছে, সে–ও মায়ের কাছে চলে যেতে চায়।

গত শুক্রবার ভোরে ডেঙ্গুতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন প্রাইম ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার ফারজানা শারমিন। এরপর থেকেই তাঁর দুই সন্তান আইয়ান ও রিদ্বীনকে সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের। ফাতিহা রাজধানীর বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। একই স্কুলের প্লে-গ্রুপে পড়ছে আইয়ান।

স্বামী ও ছেলে–মেয়েকে নিয়ে প্রাণবন্ত পরিবার ছিল ফারজানা শারমিনের

শনিবার সন্ধ্যায় কথা হয় ফারজানা শারমিনের স্বামী জাহেদুল আলমের সঙ্গে। তিনি সমকাল–এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে স্ত্রীর মৃত্যু, অপরদিকে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যতের নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে নামার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। বললেন, ‘ছোট ছেলের সবকিছু বোঝার বয়স হয়নি। মেয়ে বুঝতে পারলেও বলছে মায়ের কাছে চলে যাবে। তাই মেয়েকে বারবার বলছি, মা বলে গেছে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। মা যেখানে গেছেন, ইচ্ছা করলেই সেখানে যাওয়া যায় না।

মায়ের জন্য দোয়া করতে বলছি। ঢাকায় ফিরে শুরু হবে নতুন সংগ্রাম। দুজন মিলে ছেলেমেয়েকে সামলে রাখতাম, এখন দায়িত্বটা একাই পালন করতে হবে। একই ভবনে ছেলেমেয়েদের এক খালা থাকেন, সেটাই বড় ভরসা।’

এইটুকু বয়সে মাকে হারাল দুই ভাই–বোন আইয়ান ও ফাতিহা

মারা যাওয়ার পরে ফারজানার লাশ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর কাঁঠালবাগান ঢালের বাসায়। পরে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া গ্রামে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

জাহেদুল আলম জানালেন, ফারজানা শারমিনের মা মারা গেছেন চার বছর আগে। ফারজানা মা অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। তাই ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের কবরের পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে তাঁকে। জাহেদুল আলমের বাড়ি রাঙামাটি।

১৩ আগস্ট ছিল ফারজানা শারমিনের জন্মদিন। ওই দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ত্রী ও বাচ্চাদের ছবি পোস্ট করে জাহেদুল আলম লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন প্রিয়...’। কেক সামনে নিয়ে হাসিমুখে ছবি তুলেছিলেন ফারজানা শারমিন। জাহেদুল আলম জানালেন, ফারজানা হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করতেন। তাই প্রাইম ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখার অফিসেও জনপ্রিয় ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও কিছু কাজ জমে আছে বলে অফিসে গিয়েছিলেন। তবে শরীর বেশি খারাপ লাগায় বাসায় ফিরে এসেছিলেন।

ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেন ফারজানা শারমিন। আর জাহেদুল আলম পড়াশোনা করেছেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে। ছাত্রজীবনেই তাঁদের পরিচয়। এরপর প্রেম ও বিয়ে। বিবাহিত জীবনের গত ১২ বছরে নিজেদের মতো করে সংসার গুছিয়ে নিয়েছেন। সেই সাজানো সংসার এখন তছনছ হয়ে গেল।

স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে এখন আর এমন আনন্দভ্রমণে বের হওয়া হবে না জাহেদুল আলমের

ফারজানা শারমিনের আর্থ্রাইটিসের সমস্যা ছিল। গত শনিবার হালকা জ্বর আসে তাঁর। জ্বর নিয়েই পরদিন রোববার অফিস করেন। এর এক দিন পরে রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তবে রক্তের প্লাটিলেট (অণুচক্রিকা) ভালো থাকায় বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু গত মঙ্গলবার প্লাটিলেট অস্বাভাবিক গতিতে কমতে থাকলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন দুপুরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা ৫০ মিনিটে মারা যান তিনি।

জাহেদুল আলম বলেন, ‘তাঁকে (ফারজানা) বাঁচানোর জন্য চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু লাভ হয়নি। সময় দেয়নি। চিকিৎসকেরা বৃহস্পতিবারই লাইফ সাপোর্ট খুলে দিতে চেয়েছিলেন, আমরা বলেছিলাম আর একটু দেখি, যদি ফিরে আসে। কিন্তু ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে কারও পক্ষেই আর কিছু করা সম্ভব ছিল না।’