আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কড়াইল বস্তির সহস্রাধিক ঘর। বুধবারের ছবি
আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কড়াইল বস্তির সহস্রাধিক ঘর। বুধবারের ছবি

কড়াইলের আগুনে পুড়ে গেছে ‘পরিচয়’

একের পর এক ভূমিকম্পের ঘোরের মধ্যে থাকতে থাকতেই ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে গেল রাজধানীতে। ভূমিকম্পে কাচের প্লেট আর শোপিস পড়ে ভেঙে যাওয়া অথবা বেকুফির কারণে পা মচকানোর শোকে যাঁরা বিহ্বল ছিলেন, তাঁরা দেখলেন শহরের একাংশের মানুষের সব হারানোর দৃশ্য।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, কড়াইল বস্তিতে ২৫ নভেম্বর মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুন লাগার পর ১৬ ঘণ্টার চেষ্টায় পরের দিন সকাল ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।

ঢাকায় আগে অনেক বস্তি ছিল, ঘুরেফিরে সেগুলোতে প্রায়ই আগুন লাগত। এখন চোখে পড়ার মতো বস্তি একটাই, তাই ঘুরেফিরে সেখানেই বারবার আগুন লাগে। কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুনে সব হারানো মানুষেরা বলছেন, আগুন তাঁদের যেন নিত্যসঙ্গী। পার্থক্য শুধু আজ বস্তির উত্তর তো কদিন বাদে দক্ষিণে আগুন লাগে। কখনো কখনো বছরের দু–তিনবারও আগুন লাগে।

গওহার নঈম ওয়ারা

আবু হানিফ ১৯৯৯ সাল থেকে এই বস্তিতে থাকেন। তাঁর কথায়, এখন পর্যন্ত বড় বড় আগুন লেগেছিল ২০০৪, ২০১৭, ২০২৫ সালে।

২০১৭ সালের আগুনের পর ক্ষতিগ্রস্ত শিশু আর তাদের পরিবারকে সহযোগিতার কাজ করার সময় এক তরুণীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এখানে কেন বারবার আগুন লাগে? উত্তর না দিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আগুন লাগে নাকি লাগানো হয়, অনেকবারই তো পুড়ল বস্তি। সব আগুন কি আমাদের কারণেই হয়। বস্তি বলে তদন্ত হয় না। আমরা ফকির হলে, মরে গেলে কার কী আসে যায়!’

ক্লাস নাইনের সেই তরুণীর কথার জবাব আমাদের ছিল না। তবে এমন চপেটাঘাত মার্কা উত্তর খুব কম হয়। অভিজাত এলাকার লেক ঘেঁষে ৯০ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই বস্তির জমির প্রতি সরকারি–বেসরকারি অনেক ‘পাগলা বাবার’ নজর থাকতেই পারে।

রীতি মেনেই প্রতিবার পুড়ে যাওয়া বস্তির ‘ময়নাতদন্ত’ হয়। একাধিক কমিটি হয়। কখনোই সেসব কমিটিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নেওয়া হয় না। এবারও পাঁচ সদস্যের কমিটি হয়েছে। ২৬ নভেম্বর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কমিটি আগুন লাগার কারণ এবং সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। এই কমিটিতেও কড়াইলবাসীরা নেই। আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানতে হলে কমিটির পূর্ণ সদস্যের মর্যাদায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতিনিধিত্বের কোনো বিকল্প নেই।

কড়াইলবাসীদের প্রতিনিধিত্বহীন এ কমিটিতে একজন নারীর নাম পাওয়া যাবে না। দেশে কি আগুন বোঝা নারীর এতই আকাল?

অনেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্দশার ফিরিস্তি দিয়ে চাঁদা তুলছেন, মানুষ মুক্তহস্তে দানও করছেন। সন্দেহ নেই মানুষের ত্রাণ প্রয়োজন। তবে তাঁদের অগ্রাধিকার কী সেটা বিবেচনায় নেওয়াটা খুব জরুরি। খাবার, কাপড়, কম্বল, টিন দরকার আছে। তবে এবারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে এখন মানুষ টিন, বাঁশ জোগাড় করে ঘর তুলছে—তবু তাঁদের সবচেয়ে বড় লড়াই ঘর বানানো নয়, প্রমাণ করা—‘আমরা কারা’; পরিচয়ের কাগজ ছাড়া কেউ এখন ঘর ভাড়া নিতে পারেন না, চাকরি পেতে পারেন না, ভোটও দিতে পারেন না। আগুন ঘর পুড়িয়েছে, পাশাপাশি কড়াইলের মানুষদের পরিচয় হারানোর মতো বড় এক বিপর্যয়ে ফেলে দিয়েছে।

যেসব শিশু স্কুলে যেত তাদের অনেকের পরীক্ষা চলছিল, কারও পরীক্ষা শুরু হবে ৭–৮ ডিসেম্বর থেকে। এদের অনেকেরই বই–খাতা নেই। গত বছরের একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাব থেকে জানা যায়, কড়াইলে প্রায় ১৬টি স্কুল এবং ৩–৪টি মাদ্রাসা আছে। আগুনের আগপর্যন্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পাঠদান চলত। কয়েক হাজার শিশু (১৮ বছরের নিচে) ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বস্তির আগুনে ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে ‘মায়ের দোয়া বিদ্যা নিকেতন অ্যান্ড হাইস্কুল’।

শিক্ষার্থীদের কথা

যেসব শিশু স্কুলে যেত তাদের অনেকের পরীক্ষা চলছিল, কারও পরীক্ষা শুরু হবে ৭–৮ ডিসেম্বর থেকে। এদের অনেকেরই বই–খাতা নেই। গত বছরের একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাব থেকে জানা যায়, কড়াইলে প্রায় ১৬টি স্কুল এবং ৩–৪টি মাদ্রাসা আছে। আগুনের আগপর্যন্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পাঠদান চলত। কয়েক হাজার শিশু (১৮ বছরের নিচে) ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বস্তির আগুনে ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে ‘মায়ের দোয়া বিদ্যা নিকেতন অ্যান্ড হাইস্কুল’। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লে–গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান হতো।

শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই কম আয়ের পরিবার থেকে আসে। আগুনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় তলা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পাঠদান আর আসন্ন পরীক্ষাগুলো ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এখানে পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। আগুনের দিন পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। এখানে প্রায় ৪২০ জন শিক্ষার্থী আছে, যার মধ্যে ৩০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী। এখন কী হবে?

একবুক হতাশা নিয়ে একজন শিক্ষক জানালেন, ‘আগুনের কারণে আপাতত সব ক্লাস বন্ধ থাকবে। পরীক্ষা পেছানো হবে, তবে এখনো নতুন তারিখ ঠিক হয়নি।’ কাছেই বিদ্যাসাগর স্কুলের ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থী মিনা জানাল, ‘আগুনে সব বই-খাতা পুড়ে গেছে, এককাপড়ে বের হইছি মায়ের লগে। স্কুলড্রেসটাও নেই। এর মধ্যে ৭ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা।’ সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে তার কাছে। যেসব শিশু জানুয়ারিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল জন্মনিবন্ধনের সনদ ছাড়া সে ভর্তি হবে কীভাবে?

বড়দের সমস্যা আরও প্রকট

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), জন্মসনদ, গার্মেন্টস/অফিসের পরিচয়পত্র (আইডি)—কিছুই বাঁচেনি অনেকের। তাঁরা কাজে ফিরবেন কীভাবে? যে কিশোর ‘ডেলিভারি রাইডার’ ছিল, তার মুঠোফোনের স্ক্রিনে লেখা আসে: ‘আইডেনটিটি ভেরিফিকেশন রিকোয়ার্ড’। কাজটা এবার সে হারাবে নিশ্চয়ই। কোম্পানি বলছে, আইডি ছাড়া নেবে না। তার মানে আগুন শুধু ঘর না—ওখানকার মানুষদের জীবনটাই থামিয়ে দিয়েছে। পরিচয়হীন অজ্ঞাত করে ফেলেছে।

অভিযোগ আছে, অনেক পরিবার পরিচয়পত্র বা এনআইডি নম্বর না থাকায় দেরি বা অনেক ক্ষেত্রে ত্রাণ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে/হবে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক নাকি বলেছেন, ‘বস্তির বাসিন্দারাও অন্য নাগরিকদের মতো সব নাগরিক সেবা পাওয়ার অধিকারী। কাউকে বাদ দেওয়া হবে না—প্রতিটি ভোটারই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’ কিন্তু কবে, কখন? আমাদের বুঝতে হবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এখন ঘর-দরজা বা জিনিসপত্র হারানোর থেকেও বড় এক সংকটের মুখে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশে চাকরি, ব্যাংকিংসহ প্রায় সব সেবাই পরিচয় যাচাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। আর সেই কাগজপত্র হারিয়ে যাওয়ায় অনেকেই এখন সরকারের চোখে, ব্যবস্থার চোখে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার—বিশেষ করে গার্মেন্টস, কুরিয়ার, নির্মাণ, রাইড শেয়ারিং ও ডেলিভারি সেক্টর—ডিজিটাল পরিচয় যাচাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। কাগজপত্র ছাড়া শ্রমিকেরা পারেন না—

• বয়স বা পরিচয় যাচাই করতে

• বায়োমেট্রিক মেশিন ব্যবহার করে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে

• মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানে (যেমন বিকাশ/নগদ) বেতন পেতে

• কারখানার পরিচয়পত্র রি–ইস্যু করতে

• চিকিৎসাসেবা নিতে

• নতুন সিম নিবন্ধন করতে

• নতুন চাকরিতে আবেদন করতে

কড়াইলের ভেতরেই আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের সুযোগসহ জরুরি পরিচয় পুনরুদ্ধার ক্যাম্প খোলা এখন সময়ের দাবি। ইতিমধ্যেই এসব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে অগ্রগতি দৃশ্যমান করতে হবে দ্রুত। এটা ত্রাণের চেয়েও জরুরি। কড়াইলে ক্যাম্প করে এখনই যেসব সেবা দেওয়া প্রয়োজন:

• হারানো কাগজপত্রের সাধারণ ডায়েরি (জিডি)

• জরুরি এনআইডি রিইস্যুর আবেদন

• ডিজিটাল জন্মসনদের কপি

• চাকরির পরিচয়পত্র পুনরায় ইস্যুর সমন্বয়

• নতুন সিম নিবন্ধন

এখন মানুষ টিন, বাঁশ জোগাড় করে ঘর তুলছেন—তবু তাঁদের সবচেয়ে বড় লড়াই ঘর বানানো নয়, প্রমাণ করা—‘আমি কে? আমরা কারা?’

লেখক: গবেষক

wahragawher@gmail.com