
শহীদদের স্মরণে প্রতীকী কবর নির্মাণ, স্মৃতিচারণা, ল্যান্ডস্ক্যাপিং ও লাইটিং করা হবে।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে আর্ট প্রদর্শনী, ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী, পোস্টার প্রদর্শনী, অনলাইন ভিডিও তৈরিসহ আর্কাইভিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি গেদারিং ও আর্কাইভিং ফান্ড সংগ্রহ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে ১৭টি প্রকল্প বা স্কিম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি ৮টি প্রকল্প ঢাকা উত্তর সিটির অন্যান্য বিভাগ থেকে বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কত খরচ হবে, এর প্রাক্কলন এখনো করা হয়নি।
গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে বাস্তবায়ন করতে যাওয়া প্রকল্পগুলো গত ২৫ জুন অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটির সপ্তম করপোরেশন সভায় (বোর্ড সভায়) অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকৌশল বিভাগ থেকে বাস্তবায়ন করতে যাওয়া ৯টি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে গণমিনার, ভাস্কর্য, মঞ্চ, তোরণ নির্মাণসহ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের চিত্র প্রদর্শনী ও অভ্যুত্থানের ঘটনাবলির আলোকে দেয়ালচিত্র অঙ্কন। এ ছাড়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে আর্ট প্রদর্শনী, ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী, পোস্টার প্রদর্শনী, অনলাইন ভিডিও তৈরিসহ আর্কাইভিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি গেদারিং ও আর্কাইভিং ফান্ড সংগ্রহের বিষয় রয়েছে।
জুলাই শহীদদের স্মরণে রাজধানীর বিজয় সরণি–সংলগ্ন খোলা জায়গায় গণমিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জুলাই শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী প্রতিটি সিটি করপোরেশন নিজেদের মতো করে বিভিন্ন পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন এলাকাতেও শহীদদের স্মরণে কী কী করা যায়, সেগুলোর পরিকল্পনা করা হয়; যা পরবর্তী সময়ে বোর্ড সভায় অনুমোদন নেওয়া হয়।
জুলাই শহীদদের স্মরণে রাজধানীর বিজয় সরণি–সংলগ্ন খোলা জায়গায় গণমিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় শহীদদের স্মরণে প্রতীকী কবর নির্মাণ, স্মৃতিচারণা, ল্যান্ডস্ক্যাপিং ও লাইটিং করা হবে। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে। আর ২০ লাখ টাকা প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয়।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশলীরা জানান, চন্দ্রিমা উদ্যান মোড় থেকে পূর্ব দিকে বিজয় সরণি মোড় পর্যন্ত বিজয় সরণি এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বীর উত্তম মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান সড়কের মাঝখানে বড় একটি খোলা জায়গা রয়েছে। ওই জায়গাতেই গণমিনার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে দরপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে বলেও জানান সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিস্তারিত ব্যয়ের বিবরণ পাওয়া যায়নি।
গণমিনারের প্রস্তাবিত নকশায় দেখা যায়, বিজয় সরণির পাশে উত্তর দিকে প্রথমে ১ দশমিক ৮ মিটারের সবুজ বেষ্টনী থাকবে। তারপর ২ দশমিক ৪ মিটারের একটি হাঁটার রাস্তা। পরের পাশের খোলা জায়গায় হবে মেমোরিয়াল পার্ক। যেখানে প্রতীকী কবর করা হবে। প্রতীকী কবরগুলোর পর ২ ফুট প্রস্থের একটি দেয়াল বানানো হবে। প্রস্তাবিত নকশায় দেয়ালটিকে ‘স্টোরি ওয়াল’ বা গল্পদেয়াল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেয়ালটিতে আন্দোলনের ছবি, শিল্পকর্ম কিংবা লেখাচিত্র থাকবে। আর আজিজুর রহমান সড়কের আগে পর্যায়ক্রমে ১ দশমিক ৮ মিটারের হাঁটার রাস্তা ও ১ মিটার প্রস্থের সবুজের বেষ্টনী থাকবে।
গণমিনারের বিস্তারিত ব্যয় জানতে ঢাকা উত্তর সিটির ৫ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।
বিজয় সরণিতে গণমিনার নির্মাণের পাশাপাশি ভাস্কর্য নির্মাণ করবে ঢাকা উত্তর সিটি। ভাস্কর্য নির্মাণের এ প্রকল্প করা হবে বিজয় সরণি মোড়ের উত্তর পাশে। আগে যে জায়গাটিতে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’ ছিল। এ প্রকল্পের আওতায় জুলাই শহীদদের স্মরণে ভাস্কর্য বানানোর পাশাপাশি উন্মুক্ত জায়গা তৈরি করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা চূড়ান্তকরণ ও দরপত্র আহ্বানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা।
প্রাক্কলিত ব্যয় অনুযায়ী, পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে প্রায় ১৪ হাজার ৬৫০ বর্গফুট জায়গায়। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া উন্মুক্ত স্থানের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে ২ কোটি ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এর বাইরে ওই প্রকল্পে ৭৯ লাখ ২০ হাজার টাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বিভিন্ন ফুল, গাছ ও ঘাস লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর উন্মুক্ত থিয়েটারে ৬৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, বসার জায়গা তৈরিতে পৌনে ৯ লাখ টাকা এবং সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আলোকসজ্জার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৮ জুন ওই জায়গার ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’-এর ম্যুরাল-সংবলিত সাতটি দেয়ালও ভেঙে ফেলা হয়েছে। সাতটি দেয়ালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের দিন পর্যন্ত বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চিত্রিত হয়েছিল। এর আগে গত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই ওই প্রাঙ্গণে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
জুলাই শহীদদের স্মরণে তিনটি তোরণ ও দুটি মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনের আর্ট প্রদর্শনী, আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও অভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্র আঁকা হবে। এ সাত প্রকল্পে আরও সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মধ্যে বাড্ডায় বৌদ্ধমন্দির–সংলগ্ন এলাকায় স্বাধীনতা তোরণ নির্মাণে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় মুক্তি তোরণ নির্মাণে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং বছিলা মোড়ে আরেকটি মুক্তি তোরণ নির্মাণে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। দুটি মঞ্চের মধ্যে একটি করা হবে আন্দোলনে শহীদ মীর মুগ্ধর নামে, যা ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-১–এর আওতাধীন উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে রবীন্দ্র সরণিতে করা হবে। এ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ লাখ টাকা। আর ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে উত্তরা উত্তর মেট্রোস্টেশনের গোলচত্বরে জুলাই নারী মঞ্চ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
উত্তরা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মেট্রোস্টেশন ও সংলগ্ন স্থানে দেয়ালচিত্র আঁকা হবে। জুলাই আন্দোলনের আর্ট প্রদর্শনী নামে এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে নির্বাচিত দেয়াল, মেট্রোরেলের পিলার, উড়ালসড়কেও দেয়ালচিত্র আঁকবে সংস্থাটি। এতে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের দুঃশাসন ও জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই আন্দোলন কোনো দল কিংবা প্রতিষ্ঠানের নয়, এটা সবারই একটি বড় ইতিহাস। এর মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে সিটি করপোরেশন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক উদ্যোগ নিয়ে এখনো ভাবা হচ্ছে, চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রশাসক বলেন, যেগুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে, এর মধ্যে নীতিমালার মধ্যে যেসব উদ্যোগ সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা যাবে, সেগুলো করপোরেশন করবে। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে করপোরেশন সমন্বয় করবে, অন্যদের এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করা হবে। এ ক্ষেত্রে হয়তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করা হবে।