মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। এ সময় হতাহতদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। এ সময় হতাহতদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন

বার্ন ইনস্টিটিউটে কান্নাভেজা স্তব্ধ এক সন্ধ্যা

  • কেউ পানি, স্যালাইন, শুকনা খাবার বিতরণ করছেন। হাসপাতালের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের প্রবেশ রোধে কাজ করছেন।

  • জরুরি বিভাগের ভেতরে পা ফেলতেই চোখে পড়ে উদ্বিগ্ন মুখের সারি। কারও চোখ ভেজা, কারও চোখ স্তব্ধ, শূন্য।

সোমবার সন্ধ্যা! জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে তখন চিৎকার, কান্না, আহাজারি আর রক্তের জন্য আকুতি। সব মিলিয়ে সেখানকার বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। জরুরি বিভাগের ভেতরে পা ফেলতেই চোখে পড়ে উদ্বিগ্ন মুখের সারি। অনেকেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউবা মুঠোফোনে বারবার ফোন করে জানতে চাইছেন প্রিয়জনের খবর। কারও চোখ ভেজা, কারও চোখ স্তব্ধ, শূন্য। সবার মুখে মুখে মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার বর্ণনা।

হেল্প ডেস্কের সামনে কাঁদতে দেখা গেল মাঝবয়সী এক নারীকে। তাঁর ছেলে মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বোরহান উদ্দিন। ছেলের ছবি দেখিয়ে জানতে পারেন, ছেলে বার্ন ইনস্টিটিউটেই আছে। কাঁদতে কাঁদতে বোরহানের মা বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ভিতু। সকাল আটটার দিকে বের হয়েছে। আমি আমার ছেলেকে একটু দেখতে চাই।’

হঠাৎই একটি কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে মধ্যবয়সী এক পুরুষ কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লেন। তাঁকে ধরে রেখেছেন আরেকজন পুরুষ। তিনি জানালেন, কাঁদতে থাকা ব্যক্তির নাম রুবেল, সম্পর্কে তাঁর ভায়রা। এই মাত্র ছেলে তানভীর আহমেদের মৃত্যুসংবাদ পেলেন তিনি।

বেসরকারি চাকরিজীবী রুবেলের দুই ছেলেই মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে তানভীর অষ্টম শ্রেণিতে, ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে। দুর্ঘটনার সময় দুজনই স্কুল বাসে ছিল। ছোট ছেলে সুস্থ থাকলেও বড় ছেলে আর ফেরেনি।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ইনস্টিটিউটের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় চিকিৎসা চলছে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের। এর মধ্যে চতুর্থ তলায় আইসিইউ।

রুবেলের দুই ছেলেই মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে তানভীর অষ্টম শ্রেণিতে, ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে। দুর্ঘটনার সময় দুজনই স্কুল বাসে ছিল। ছোট ছেলে সুস্থ থাকলেও বড় ছেলে আর ফেরেনি।

লিফটে উঠতেই দেখা গেল, এক কোণে ডুকরে কাঁদছেন মধ্যবয়সী এক নারী। লিফট থামল চতুর্থ তলায়। সেখানে নামতেই দেখা গেল, মেঝেজুড়ে উদ্বিগ্ন মুখ। কারও চোখ ছলছল, কেউ কাঁদছেন। একটি কক্ষে বসে আহাজারি করছিলেন কয়েকজন নারী। আইসিইউর সামনে স্বজনদের ভিড়। কেউ কেউ দরজার ফাঁক দিয়ে একবার চোখ মেলে প্রিয়জনকে দেখার আকুতি জানাচ্ছেন।

প্রবেশমুখের এক পাশে একটি সাদা বোর্ডে কালো কালি দিয়ে লেখা—মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের নাম ও আইসিইউ বেড নম্বর। লেখা আছে:

 ১২. শায়ান ইউসুফ—৯৫%

 ০৮. মাহতাব—৮৫%

 ১৪. মাহিয়া তাসনিম—৫০%…এমন নয়টি নাম। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালি মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে।

আহত ব্যক্তিদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। এ সময় রক্ত দিতে জরুরি বিভাগের সামনে জড়ো হন অনেকে

বোর্ডের পাশেই সজল চোখে কানে ফোন ধরে আছেন মধ্যবয়সী এক পুরুষ। বললেন, ‘আমার অবস্থা ভালো না। আমার ছেলেটা আইসিইউতে।’ ফোন নামিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললেন তিনি। জানালেন, তিনি সায়ান ইউসুফের বাবা—মোহাম্মদ ইউসুফ। নিজেও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। তাঁর ছেলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।

বাইরে বের হতেই চোখে পড়ে স্বেচ্ছাসেবী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। কেউ পানি, স্যালাইন, শুকনো খাবার বিতরণ করছেন। হাসপাতালের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের প্রবেশ রোধে কাজ করছেন।

রক্ত দিতে আসা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। হাসপাতালের এক পাশে দাঁড়িয়ে মাইকিং করে বলা হচ্ছে, ‘এই মুহূর্তে রক্তের প্রয়োজন নেই। আপনারা পরে যোগাযোগ করুন।’ তবু কেউ সরছেন না। দাঁড়িয়ে থাকছেন, হয়তো আবার ডাক আসবে এমন আশা নিয়ে। এমনই একজন আসাদুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘আমার রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। এখন না লাগুক, পরে তো লাগতেই পারে। বাচ্চাগুলো তো শেষ হয়ে গেল, ভাই।’

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে আবারও সাইরেন বাজিয়ে ঢুকছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। স্বেচ্ছাসেবকেরা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যান সড়কের বাড়তি ভিড় সরাতে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। কিন্তু বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে যেন সময় থেমে আছে। একেকটি পরিবার ছুটে চলেছে এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে—প্রিয়জনের খোঁজে। ডাক্তার-নার্সদের চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট, তবু কেউ দম নিচ্ছেন না।

শুধু হাসপাতালের নয়—এই রাত যেন গোটা শহরের এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। শুধু যাঁরা সন্তান হারিয়েছেন, তারাই নন—যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মনেও রয়ে যাবে গভীর ক্ষত।