জাতীয় চিড়িয়াখানা

নিঃসঙ্গ উল্লুকটির জন্য সঙ্গী খোঁজা হচ্ছে

সঙ্গীকে হারিয়ে খাঁচায় একা রয়েছে হলদে ধূসর রঙের উল্লুকটি। বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, মিরপুর, ঢাকা।
ছবি: আশরাফুল আলম

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় দুই মাস আগে দুটি উল্লুক ছিল। একটি কালচে, অন্যটি হলদে ধূসর রঙের। ছোট্ট খাঁচাতেও প্রাণী দুটির ছোটাছুটির কমতি ছিল না। মিষ্টি-মধুর স্বরে ডাকাডাকি করত। দুই মাস আগে কালচে উল্লুকটি মারা যায়। একা হয়ে পড়ে সেটির সঙ্গী। এখন ছোট্ট খাঁচায় নিঃসঙ্গ উল্লুকটি সঙ্গীকে খুঁজে ফিরে, ডাকে। তবে সেই ডাক এখন আর মধুর নেই, আর্তনাদে রূপ নিয়েছে।

চিড়িয়াখানার একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সকালে উল্লুক দুটি বেশি ডাকাডাকি করত। তখন প্রাণী দুটির ডাক মিষ্টি লাগত। এখন নিঃসঙ্গ উল্লুকটি উচ্চ স্বরে ডাকাডাকি করে। শুনতে ভয়ংকর লাগে। প্রাণীটি হয়তো মনে করে, উচ্চ স্বরে ডাকলে সঙ্গী ফিরে আসবে।

তবে চিড়িয়াখানার কর্মকর্তাদের দাবি, একা হয়ে পড়া উল্লুকটি এখন আগের চেয়ে জোরে ডাকে না। প্রাণীটির ডাকই এমন। আগেও এভাবে ডাকত।

একটি উল্লুকের বয়স হয়েছিল। এ কারণে সেটি নানা জটিলতায় ভুগে মারা গেছে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। এখন যেটা আছে, সেটা সুস্থ। আমরা প্রাণীটির জন্য সঙ্গী খুঁজছি।
রফিকুল ইসলাম তালুকদার, পরিচালক, জাতীয় চিড়িয়াখানা।

গত ৬ ডিসেম্বর চিড়িয়াখানায় থাকা কালচে রঙের উল্লুকটি মারা যায়। বয়স হয়েছিল ২৬ বছর ৯ দিন। সেটি স্ত্রী উল্লুক ছিল। এখন যেটা রয়েছে, সেটাও স্ত্রী উল্লুক। বয়স প্রায় ১৬ বছর। দুটি উল্লুকই স্ত্রী হওয়ায় চিড়িয়াখানায় সন্তান জন্ম দিতে পারেনি।

চিড়িয়াখানার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কালচে রঙের উল্লুকটি মারা যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিল। খাওয়াদাওয়া কম করত। চুপচাপ বসে থাকত। প্রাণীটির চিকিৎসা চলছিল। সঙ্গীকে হারিয়ে অন্য উল্লুকটি এখন অস্থির হয়ে উঠেছে। চিড়িয়াখানার ওই কর্মী বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উল্লুকটি থেমে থেমে ডাকাডাকি করে।

জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি উল্লুকের বয়স হয়েছিল। এ কারণে সেটি নানা জটিলতায় ভুগে মারা গেছে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। এখন যেটা আছে, সেটা সুস্থ। আমরা প্রাণীটির জন্য সঙ্গী খুঁজছি।’

উল্লুকটিকে খাবার খাওয়াচ্ছেন একজন। বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, মিরপুর, ঢাকা।

তবে রফিকুল ইসলাম তালুকদারের মতে, বেঁচে থাকা উল্লুকটিরও বেশ বয়স হয়েছে। তাই পুরুষ সঙ্গী দিলেও সেটি বাচ্চা জন্ম না-ও দিতে পারে। রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা এখন তুলনামূলক অল্প বয়সের উল্লুক কিনতে চাইছি। তাই বাচ্চা হওয়ার আশা বাদ দিয়েই বেঁচে থাকা উল্লুকটির জন্য সঙ্গী আনতে চাইছি। সেটির একাকিত্ব দূর করতে চাইছি। এ জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে।’

নতুন করে চারটি উল্লুক কেনার পরিকল্পনা করেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এতে খরচ হবে প্রায় ৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে দুটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী উল্লুক। উল্লুক রাখার জন্য বর্তমানে চিড়িয়াখানায় দুটি খাঁচা আছে। এখন যে উল্লুকটি আছে, সেটার সঙ্গে আরও দুটি উল্লুক দেওয়া হবে, যার একটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ। খালি পড়ে থাকা খাঁচায় বাকি দুটি উল্লুক রাখা হবে।

চিড়িয়াখানায় থাকা উল্লুকটির ইংরেজি নাম হুলক গিবন (Hoolock Gibbon)। বৈজ্ঞানিক নাম হুলক হুলক (Hoolock hoolock)। দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং ভারত, মিয়ানমার ও চীনে উল্লুকের বসবাস।

যেই প্রাণী দেশে পাওয়া যায়, সেই প্রাণী কেন কিনতে হবে, জানতে চাইলে চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘দেশের আইন অনুযায়ী বন্য প্রাণী ধরা ও বন্দী করা অপরাধ। ফলে দেশ থেকে উল্লুক সংগ্রহ করার আইনগত এখতিয়ার আমাদের নেই। এ ছাড়া দেশ থেকে উল্লুক কেনার মতো বৈধ কোনো উৎস নেই। বিদেশে বৈধ কিছু খামারের মতো আছে, যেখানে বন্য প্রাণী প্রজননের পর বিক্রি করা হয়। দরপত্রের মাধ্যমে সেসবের কোনো উৎস থেকে উল্লুক কিনতে হবে।’

উল্লুক লেজবিহীন প্রাণী। দৈর্ঘ্য গড়ে সাড়ে পাঁচ সেন্টিমিটার। ওজন গড়ে ৬ দশমিক ৭ কিলোগ্রাম। পাঁচ বছর বয়সে স্ত্রী উল্লুক বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। ৪৭ মাস গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। এরা গেছো স্বভাবের। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসবাস করে। একেকটি দলে একটি পুরুষ, একটি স্ত্রী ও কয়েকটি বাচ্চা উল্লুক থাকে। দিনের শুরুতে এরা উচ্চ স্বরে ডাকে। ফল, ছোলা, পাউরুটি, শসা, চিনাবাদাম, সেদ্ধ ডিম উল্লুকের পছন্দের খাবার।

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে উল্লুক বাস করে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সেখানে গিয়ে দেখতে পারে উল্লুক কী ধরনের গাছে কীভাবে থাকে। সেই অনুযায়ী উল্লুকের জন্য চিড়িয়াখানায় যথাযথ আবাস তৈরি করে দিতে হবে।
হাবিবুন নাহার, সহযোগী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিপন্ন প্রাণী উল্লুক। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকায় রয়েছে প্রাণীটি। বাংলাদেশে কী পরিমাণ উল্লুক আছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল মাল্টিডিসিপ্লিনারি ডিজিটাল পাবলিশিং ইনস্টিটিউটে (এমডিপিআই) বাংলাদেশের উল্লুকের ওপর একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৩৬৮টি উল্লুকের দেখা মিলেছে।

ওই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুন নাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে উল্লুক বাস করে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সেখানে গিয়ে দেখতে পারে, উল্লুক কী ধরনের গাছে কীভাবে থাকে। সেই অনুযায়ী উল্লুকের জন্য চিড়িয়াখানায় যথাযথ আবাস তৈরি করে দিতে হবে। পরিবেশ তৈরি করতে হবে। স্ত্রী ও পুরুষ উল্লুক একসঙ্গে রাখতে হবে। তা না হলে বনের প্রাণী ধরে এনে কষ্ট দেওয়া বা মেরে ফেলা উচিত হবে না।