ছাদকৃষি

এক দম্পতির সবুজের আহ্বান

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে নিজেদের ছাদবাগানে সাইফুল্লাহ খোকন ও মাসুদা আক্তার দম্পতি। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বাতাসে দোল খাচ্ছে পেয়ারাগুলো। গাছেই পেকে গেছে কয়েকটা। ঘ্রাণ আসছে। পাশেই দেখার আনন্দ হয়ে আছে ব্যানানা আম। আর সবুজ পাতার আড়ালে যেন লুকিয়ে আছে ডজনখানেক মাল্টা। আরেক পাশে গোলাপসহ কত ফুলের হাসি! কত ধরনের গাছ, ফল আর সবজি যে আছে বাগানটিতে।

গত ২১ জুন শনিবারের সকালটা ছিল এই মৌসুমের আর দশটি দিনের মতোই। আষাঢ়ের দিন যেমন হয়ে থাকে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের বাড়বাড়ন্ত। তার ফলে জনজীবনে ক্লান্তিকর উষ্ণতা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর রমনার ১৫ সিদ্ধেশ্বরীর ছয়তলার অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে উঠতেই শ চারেক গাছের নীরব অভিবাদন মনে এনে দিল সুখানুভূতি।

গাছপাকা পেঁপে

সাইফুল্লাহ খোকন ও মাসুদা আক্তার দম্পতি এই বাড়িতে ফ্ল্যাট কিনে থাকা শুরু করেন ২০০৮ সালে। এক ছেলে, এক মেয়ে তত দিনে বড় হয়ে গেছে। ব্যাংকের চাকুরে সাইফুল্লাহ সন্ধ্যার পর এবং ছুটির দিনগুলোতে নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্য ২০১৬ সালের শুরুতে ছাদে একটি-দুটি করে গাছ লাগাতে শুরু করেন। ব্যাপারটা ছিল এ রকম, তাঁরা জামাই-বউ আগারগাঁওসহ বিভিন্ন নার্সারিতে ঘোরেন। বৃক্ষ মেলায় যান। একটা-দুটো চারা পছন্দ হলে হাতে করে নিয়ে আসেন। রোপণ করেন ছাদে। যত্ন পেয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। গাছ বড় হয়ে ফুল আসে, ফল হয়। কাঁচা মরিচ, ঢ্যাঁড়স, বেগুনের মতো কিছু সবজিও লকলক করে বেড়ে ওঠে। বিকেলে ছাদে ওঠেন এই অ্যাপার্টমেন্টের ৪৪টি পরিবারের ভাই-ভাবিরা। বাচ্চারাও ওঠে, গাছ দেখে, ফুল দেখে, ছবি তোলে। এত সব আনন্দ দেখে অ্যাপার্টমেন্ট মালিক সমিতির সবাই বলেন, ‘সাইফুল্লাহ ভাই, আপনি চার হাজার বর্গফুটের পুরো ছাদটি কেন নিয়ে নিচ্ছেন না। পুরো ছাদটিতে বাগান করুন আর আমাদের দিন আরও সতেজ স্পর্শ।’

সেই যে কাজে নেমে পড়লেন এই দম্পতি, আর থামাথামি নেই। তত দিনে ছাদকৃষি নিয়ে শুরু করেছেন পড়াশোনা। ঢাকায় আরও যাঁরা এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে। যাঁরা প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবেন, লেখালেখি করেন, তাঁদের কথাও শোনেন। এভাবে একটু একটু করে ছাদবাগানের এই সমৃদ্ধি।

ছাদে আছে হরেক রকমের গাছ

ওই দিন দুপুরে সাইফুল্লাহ ও মাসুদা আক্তার তাঁদের বাগানের রকমারি গাছের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তখন আশপাশের ভবনের ছাদগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। একটা-দুটোতে সামান্য একটু সবুজের উপস্থিতি দেখা গেল। বেশির ভাগ ছাদই শুষ্ক, ঊষর।

সাইফুল্লাহ খোকন ও মাসুদা আক্তারের ছাদবাগানে কী কী গাছ আছে, কয়েকটা উল্লেখ করা যাক। ফলের গাছের মধ্যে আছে আম, সাদা জাম, পেঁপে, পেয়ারা, আনার, ড্রাগন, সাদা জাম্বুরা, মাল্টা, কমলা, সফেদা, আমড়া, লেবু। ঔষধি গাছের মধ্যে বাসক, কিডনি প্ল্যান্ট, ইনসুলিন প্ল্যান্ট, অরিগানো, করসল, তেজপাতা, অলস্পাইস, মসলা পাতা, তুলসী।

ডায়াবেটিক রোগী মাসুদা বলছিলেন, সকালে তাঁকে ইনসুলিন নিতে হতো। এখন ইনসুলিনগাছের কয়েকটা পাতা নিয়ে রস করে টুক করে খেয়ে ফেলেন। আর রোজ সকালে সুচের গুঁতো খাওয়া লাগে না।

বাগানে ফুলের মধ্যে আছে গোলাপ, কাঁটামুকুট, সন্ধ্যামালতী, নয়নতারা, কামিনী, সিলভার কুইন, হাসনাহেনা, অ্যারোমেটিক জুঁই, স্থলপদ্ম, চাঁপা, টগর, বেলি, জারবেরা, অ্যাডেনিয়াম। সবজির মধ্যে ঢ্যাঁড়স, বেগুন, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, বারোমাসি শিম, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, ধুন্দুল, সুরমা কচু। কোনোটি বড় ড্রামে, কোনোটি মাঝারি ড্রামে আবার কোনো গাছ লাগানো হয়েছে টবে। আলুশাক, পুঁইশাক, কলমিশাক, পাটশাক, লালশাক, পুদিনাপাতা, ধনেপাতা—কোনো কিছুর অভাব নেই ছাদে।

নজরে এল, বাগানে কিছু পেয়ারা পেকে গেছে। আম ও রেডলেডি জাতের পেঁপেতে এসেছে হলুদ রং। তাঁদের অনুরোধে পাওয়া গেল বাগান থেকে পাকা ফল তোলার আনন্দ।

ছাদবাগানটিতে কয়েক শ গাছ আছে

ভোরে ওঠার অভ্যাস এই দুই ‘নাগরিক কৃষকের’। উঠেই একবার ছাদে যেতে হয়। কারণ, গাছেরা তাঁদের আহ্বান করে। সেখানে তখন অনেক পাখির ডাকাডাকি। দিনটা ভালো কাটে।

চাকরি থেকে অবসরের দিন গুনতে থাকা সাইফুল্লাহ বলছিলেন, বাগানটিতে তাঁর অন্তত দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আর প্রতিদিন দুই বেলা পরিশ্রম তো আছেই। রীতিমতো মাথাল পরে, কাস্তে হাতে বাগানে কাজ করেন ময়মনসিংহের গ্রামীণ পরিবেশে কৈশোরকাল কাটানো এই মানুষ। যখন বাগানের কোনো ফল-ফসল প্রতিবেশীর হাতে তুলে দিতে পারেন, তখন তাঁর যে আনন্দ হয়, সেটা অর্থ খরচ আর পরিশ্রমের কাছে কিছুই নয়।

নগরে ছাদকৃষিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দরকার, নিজের উপলব্ধি থেকে বললেন সাইফুল্লাহ। তাঁর কথা, সিটি করপোরেশন নিধিরাম সরদার না হয়ে এসব কাজে সহযোগিতা করতে পারে। যে ছাদে বাগান আছে, পানির বিল সেখানে অর্ধেক করতে পারে ওয়াসা।

কার ছাদবাগানটি কত বড়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই ধূলিধূসর, ইট–কাঠের নগরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করাই আসল কাজ–সেটা সাইফুল্লাহ খোকন ও মাসুদা আক্তার দম্পতি করে যাচ্ছেন। তাঁদের অভিনন্দন।