কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রাণখোলা আড্ডা, সংস্কৃতিচর্চা—সবই হয় এখানে। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডে
কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রাণখোলা আড্ডা, সংস্কৃতিচর্চা—সবই হয় এখানে। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডে

বেইলি রোড

নাটক, কেনাকাটা, খাবারের ব্যস্ততা

  • স্বাধীনতার পরে দেশে মঞ্চনাটকের যে বিকাশ ঘটেছিল, বেইলি রোডকে তার সূতিকাগার বলা যায়।

  • কেনাকাটার জন্যও বেইলি রোড বেশ জনপ্রিয়। এখানে দেশি তাঁতের শাড়ি বিক্রির জন্য আশির দশকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির’ একটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছিল।

বেইলি রোডের ব্যস্ততা কমে না। সকাল থেকে বিকেল, বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা থেকে রাতের বেশ খানিকটা পর্যন্ত—যখনই কেউ বেইলি রোডে আসবেন, দারুণ জমজমাট পরিবেশ পাবেন এখানে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রাণখোলা আড্ডা, প্রণয়-প্রণয়ী জুটির হাতে হাত রেখে নিবিড় আলাপনে সময় কাটানো, নাট্যামোদীদের মঞ্চনাটক উপভোগ আর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কোচিং নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও বই–খাতার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীর ঝাঁক বেইলি রোড প্রাণবন্ত রাখে সব সময়।

পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এই সড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক বিপণিবিতান, বিভিন্ন চেইনশপের আউটলেট, অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ, শাড়ির দোকান, দেশি বুটিকের বিক্রয়কেন্দ্র, বইয়ের দোকান, ফুলের দোকান, ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলির দোকান, কোচিং সেন্টার আর মহিলা সমিতির নাটকের বিখ্যাত মঞ্চ—কী নেই এখানে!

বেইলি রেডের পশ্চিম প্রান্ত শুরু হয়েছে রমনা উদ্যানের ‘অরুণোদয়’ ফটকের বিপরীত দিক থেকে। প্রশস্ত সড়কটির দুই পাশে অফিসার্স ক্লাব পর্যন্ত সরকারি আবাসন ও দপ্তর। এই অংশের ফুটপাতে কোনো দোকানপাট নেই। মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তারা এখানে থাকেন বলে বেইলি রোডের এই অংশই সম্ভবত ঢাকার কোলাহলমুক্ত কয়েকটি সড়কের মধে৵ অন্যতম, যেখানে সড়ক ও ফুটপাতে বাণিজ্যিক পসরা নেই। যানবাহনের চলাচলও তুলনামূলক কম।

বেইলি রোডের পরের অংশের চেহারা একেবারেই অন্য রকম। এই প্রান্ত চলে গেছে পূর্ব দিকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত। এর এক পাশে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। শান্তিনগর মোড়ের প্রান্তে রয়েছে অনেক কোচিং সেন্টার। ফলে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সকাল–বিকেল নিয়মিত এখানে যাতায়াত করতে হয়।

কেনাকাটার জন্যও বেইলি রোড বেশ জনপ্রিয়। এখানে দেশি তাঁতের শাড়ি বিক্রির জন্য আশির দশকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির’একটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছিল। পাঠককে বই পড়তে আগ্রহী করতে ‘তবুও বই পড়ুন’ স্লোগান নিয়ে ‘সাগর পাবলিশার্স’ নামে বইয়ের দোকান করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুল। পরে এখানে ‘বিদ্যা ভবন’ নামে আরও একটি বইয়ের দোকান গড়ে ওঠে। খাবারের দোকানের মধ্যে ছিল সুইস বেকারি ও ক্যাপিটাল কনফেকশনারির মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রসাধনীর জন্য ছিল বেইলি স্টার নামের একটি দোকান। কালক্রমে এখানে একের পর এক বহুতল বাণিজ্যিক ভবন আর বিপণিবিতান গড়ে ওঠে। এসব ভবনে রয়েছে হরেক রকম খাবারের অনেক রেস্তোরাঁ। কেনাকাটা আর রসনাবিলাসে এসব বিপণিবিতান আর ভোজনালয়গুলো নানা বয়সী হাজারো মানুষের সমাগমে মুখর থাকে পরিবেশ।

বেইলি রোডের কথা বললে অনিবার্যভাবে আসে মঞ্চনাটকের প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার পরে দেশে মঞ্চনাটকের যে বিকাশ ঘটেছিল, বেইলি রোডকে তার সূতিকাগার বলা যায়। এখানে ‘মহিলা সমিতি’ ও ‘গাইড হাউস’–এর দুটি মঞ্চে অভিনীত হয়েছে বহু সাড়াজাগানো নাটক। প্রতিদিন বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নাটকের দর্শক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের আড্ডায় মুখর থাকত বেইলি রোড। মূলত মঞ্চনাটক ও নাটককেন্দ্রিক আড্ডাকে কেন্দ্র করেই জমজমাট বেইলি রোডের পরবর্তী বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। এখন অবশ্য মঞ্চনাটককেন্দ্রিক আড্ডা অনেকটাই এখান থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়। তবে মহিলা সমিতি মঞ্চের নাটক একেবারে বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা গাজি ইব্রাহিম ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৩ সালে মহিলা সমিতি মঞ্চে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের বাকি ইতিহাস নাটক দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চনাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মহিলা সমিতির পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন করা হয়েছে ২০১৬ সালে। এখানে ২৪২ আসনের অত্যাধুনিক সুবিধাসংবলিত নতুন মিলনায়তন করা হয়েছে। তবে জাতীয় নাট্যশালায় একসঙ্গে তিনটি মঞ্চ চালু থাকায় মহিলা সমিতির নাটকের সংখ্যা কমে গেছে। এখন মাসে ২০-২২ দিন নাটক মঞ্চায়ন হয়। গাইড হাউসের মঞ্চ প্রায় দেড় দশক ধরে বন্ধ।

একসময় মঞ্চনাটকের নিয়মিত দর্শক ছিলেন বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সাগর রহমান। যুক্ত ছিলেন নাটকের দল থিয়েটার আর্টের সঙ্গেও। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, বেইলি রোড তো এখন শাড়ি, পোশাকের দোকান ও রেস্তোরাঁর জন্য বিখ্যাত। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে ‘নাটকপাড়া’ বলেই পরিচিত ছিল। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক ছিল বেইলি রোডে নাটকের স্বর্ণযুগ। তখন বনপাংশুল, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, সাতঘাটের কানাকড়ি, হয় বদন, কোর্ট মার্শাল, কঞ্জুসসহ অনেক কালজয়ী নাটক অভিনীত হয়েছে বেইলি রোডের দুই মঞ্চে। বিটিভিতে কাজ করেও হাতে অনেক সময় থাকত বলে বিখ্যাত অভিনেতারাও নিয়মিত মঞ্চে আসতেন। তখন একটা দর্শকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ‘বিদ্যুৎ দা’ বলে এক দর্শক ছিলেন, যিনি প্রতিটি নতুন নাটকের নিয়মিত দর্শক ছিলেন। এখন আর নাটক দেখতে বেইলি রোডে তেমন যাওয়া হয় না; কিন্তু ওদিকটায় গেলে সেই স্মৃতিগুলো ফিরে ফিরে আসে।

নাটকের আড্ডা আর আগের মতো বেইলি রোডে নেই। তবে আড্ডা বন্ধ হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে তার ধরন। দুপুরের পর থেকেই মহিলা সমিতির সামনে থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মোড় পর্যন্ত সড়কের পাশে এসে যায় পথখাবারের অর্ধশতাধিক অস্থায়ী দোকান। চটপটি, ফুচকা, কাবাব, বার্গার, পিৎজা, পাস্তা, চাওমিন থেকে হরেক রকমের খাবার গরম-গরম তৈরি করে তুলে দেওয়া হয় ক্রেতাদের হাতে। যা আশপাশের নামডাকওয়ালা বড় হোটেল, রেস্তোরাঁর তুলনায় দাম একটু সাশ্রয়ী। এখানে আড্ডা দিতে দিতে দাঁড়িয়েও রসনাবিলাসে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। আবার ফুটপাতে পেতে রাখা টুলে বসার ব্যবস্থাও আছে। মূলত অসংখ্য তরুণ–তরুণীর সমাগম ঘটে এসব পথখাবারের দোকানের সামনে। ফলে সময়ের পরিক্রমায় আড্ডার মুখ আর বিষয়ের পরিবর্তন হলেও বেইলি রোডের ব্যস্ততা রয়ে গেছে একই রকম।