দুই পাশ থেকে বিশাল সব বৃক্ষ ঝুঁকে আছে সড়কের ওপর। যেন সবুজের মায়ায় জড়ানো এক সড়ক। সম্প্রতি রাজধানীর হেয়ার রোডে
দুই পাশ থেকে বিশাল সব বৃক্ষ ঝুঁকে আছে সড়কের ওপর। যেন সবুজের মায়ায় জড়ানো এক সড়ক। সম্প্রতি রাজধানীর হেয়ার রোডে

ঢাকায় মায়াময় এক সড়ক

  • এখানে ৭০-৮০টি শতবর্ষী পাদাউক বৃক্ষ আছে।

  • সুগন্ধিযুক্ত, হলুদ রঙের পাদাউক ফুল। এটি এক দিনের ফুল। সন্ধ্যা নামার আগে ঝরে পড়ে।

ঢাকার হৃদয় চিরসবুজ রমনা। এই পার্কের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে, নাম হেয়ার রোড। ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর সড়কগুলোর একটি। এক পাশে শতবর্ষী গাছের সারি, অন্য পাশে রমনা পার্কের নিঃশব্দ ছায়া। এই রাস্তা যেন নাগরিক ব্যস্ততার মাঝেও মায়াময় প্রশান্তি এনে দেয়। সকাল, দুপুর কিংবা সন্ধ্যা—আপনি যে সময়ই রাস্তাটি দিয়ে হাঁটবেন, নাগরিক ক্লান্তি ঝরে যাবে।

সম্প্রতি এক সকালে হেয়ার রোডে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সুস্মিতা রায়ের সঙ্গে। তাঁর পেশা রাজনীতি। থাকেন সেগুনবাগিচায়। সকাল কিংবা বিকেল যখনই সময় পান, রমনা পার্কে ঘুরতে চলে আসেন। তিনি বলেন, ‘মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রমনার প্রেমে পড়া। রমনার সবুজ আমাকে কখনো ক্লান্ত করে না। আর বিশেষ করে হেয়ার রোড আমাকে মায়ায় বেঁধেছে। হেয়ার রোডের রাস্তাটুকু আমি হেঁটে পার হই। এখন অবশ্য পুরো রাস্তা ধরে হাঁটা যায় না।’

ঢাকার উত্তর প্রান্ত দিয়ে রমনায় ঢুকতে চাইলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়ে নেমে পড়তে হবে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মিন্টো রোডমুখী সোজা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। একটি ছোট গোলচত্বর পাওয়া যাবে। এবার গোলচত্বরটির ডানে ঘুরতে হবে। ধনুকের মতো বাঁক নেওয়া একটি মহিরুহ–শোভিত রাস্তা চোখে পড়বে। এটিই হেয়ার রোড।

রমনার অরুণোদয় থেকে উত্তরায়ণ ফটকের পাশ দিয়ে যাওয়া হেয়ার রোড একটি দিঘল পথই নয়—এটি একটি সংযোগ রেখা; যা ঢাকা শহরের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে একত্র করেছে। এই রাস্তা এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে ঢাকা শহরের প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক জীবনের কেন্দ্রগুলো সহজেই ছোঁয়া যায়।

আছে অদ্ভুত এক বৃক্ষ

রমনার অরুণোদয় থেকে উত্তরায়ণ—যেকোনো ফটক দিয়ে বেরিয়ে সড়কটিতে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে বিশালকায় পত্রমোচী উঁচু বৃক্ষের সারি। বৃক্ষগুলো উচ্চতায় ৩০ থেকে ৪০ মিটারের মতো। কাণ্ড অনুচ্চ, শাখায়িত, পাঁশুটে রঙের, প্রায় মসৃণ। এই বৃক্ষের নাম পাদাউক। একটি-দুটি নয়, অনেকগুলো গাছের সারি। শতবর্ষী এ বৃক্ষের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pterocarpus indicus। এর গোত্র ফ্যাবেসি। গ্রিক শব্দ টেরোকার্পাস অর্থ পক্ষল বা ডানাযুক্ত ও ইন্ডিকাস অর্থ ভারতীয়। এর ইংরেজি নাম বার্মিজ রোজ-উড। ঢাকায় পাদাউকের সবচেয়ে বড় বীথি এটি। ধারণা করা হয়, রমনা পার্কের গোড়াপত্তনের সময় উষ্ণমণ্ডলীয় অনেক বৃক্ষের পাশাপাশি রবার্ট লুইস প্রাউডলক মিয়ানমার থেকে গাছগুলো নিয়ে আসেন এখানে। তিনি ছিলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেনের কর্মী।

শতবর্ষ আগে ঢাকাকে উদ্যান-নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কাজে তাঁর প্রতি দায়িত্ব অর্পিত হয়। কাজটি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছিলেন। তাঁর প্রমাণ পাদাউকের এই নান্দনিক বীথি। বলা হয়, তাঁর হাত ধরেই এ দেশে পাদাউকের অভিষেক।

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন পাদাউক বৃক্ষ সম্পর্কে বলেন, ‘পাদাউক বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের বৃক্ষ। আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের সঙ্গে বৃক্ষটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে বাংলাদেশের সবগুলো বড় নগরীতে পাদাউক বৃক্ষ রোপণ করা প্রয়োজন। আধা কিলোমিটারের একটু কম দৈর্ঘ্যের হেয়ার রোডের দুই পাশে ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনগুলোর আঙিনা মিলে বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০টি বৃক্ষ রয়েছে।’

হেয়ার রোডে ফুটেছে স্নিগ্ধশোভার পাদাউক

পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের ফালি এসে পড়েছে হেয়ার রোডে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৬টা ৪৫ মিনিট। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে রমনাপ্রেমীদের পদশব্দ আর পাখির ডাক। রাস্তায় অল্প কিছু যান আছে, কিন্তু উচ্চকিত শব্দ নেই। রমনা পার্কের দীর্ঘ সবুজ হেয়ার রোডকে সারা বছর মায়ায় বেঁধে রাখে। হেয়ার রোডের মায়ায় বাঁধা পড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে এস এম শাহজাহান হোসেন। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে বের হয়ে ঢাকায় এসে থিতু হই। ব্যাচেলর ও সংসার জীবন মিলে রমনার আশপাশজুড়ে প্রায় তিন দশক কাটিয়ে দিলাম। রমনার বৈচিত্র্যময় সবুজ আর হেয়ার রোডের মায়া আমাকে কোথাও যেতে দিল না। একমাত্র মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, কিন্তু এই মায়াময় রমনা ছেড়ে আমি কোথায় যাই, বলুন।’

সড়কটির অন্য পাশে রয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাসভবন। বাংলো বাড়িগুলো উচ্চতায় তিনতলার সমান। একটি বাংলোর ফটকে হেয়ার রোডের নম্বর ৩৫ ঝুলছে। বাড়িটির দেয়াল ঘেঁষে পাদাউক গাছ। তাতে ফুটেছে সুগন্ধিযুক্ত, হলুদ রঙের পাদাউক ফুল। এর দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছিল পাদাউক ফুল। শ্যামলী নিসর্গ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই প্রস্ফুটনের স্মৃতি আমার চিরদিন মনে থাকবে। ১৯৬৪ সালের বসন্তের শেষে এক দিন ভোরে কলেজে যাচ্ছিলাম। জিপিওর কাছে সেকেন্ড গেটে বাস থেমেছে। হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝলক আশ্চর্য সুগন্ধ এল। প্রথমে আমারই চোখে পড়ল কাছে পাদাউক গাছ, সারা শরীর ছেয়ে নেমেছে হলুদের ঝরনাধারা।’

পাদাউক এক দিনের ফুল। সারা দিন রূপ-গন্ধ বিলিয়ে সন্ধ্যা নামার আগে ঝরে পড়ে।

হেয়ার রোডের নাম সমাজহিতৈষী স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ডেভিড হেয়ারের নাম থেকে এসেছে। তিনি স্কটল্যান্ডের একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তাঁর বাবা ছিলেন ঘড়ি তৈরির কারিগর। ১৮০০ সালে হেয়ার কলকাতায় আসেন এবং ঘড়ি তৈরি ও মেরামত করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। উপার্জিত অর্থ নিয়ে তিনি দেশে ফিরে না গিয়ে অবিভক্ত বাংলায় স্থায়ী নিবাস স্থাপন করেন এবং বাকি জীবন তিনি এ দেশের দুস্থ মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর স্মরণেই এই রাস্তার নামকরণ হয়।

গাছের ছায়ায় জড়ানো নিঃশব্দ সৌন্দর্যের এক সড়ক। রাজধানীর হেয়ার রোডে

হেয়ার রোডে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, শহরের এক টুকরা গহিন কোণ দিয়ে যাচ্ছি। ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া মানুষ, রমনায় হাঁটতে আসা প্রবীণ নাগরিক, জগিং করতে আসা তরুণ-তরুণী বিঘ্ন নয়, বরং সেই নিঃশব্দ সৌন্দর্যের অংশ।

হেয়ার রোড আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঢাকা শহরের ভেতর এখনো কিছু রাস্তা বেঁচে আছে, যেখানে শহরের গতি আর প্রকৃতির ধীরতা একসঙ্গে মিশে যায়। রাস্তাটি যেন অনন্য এক গল্প, যেখানে প্রতিটি পদচিহ্ন ছুঁয়ে যায় পরম মমতায়।

হেয়ার রোড থেকে ফেরার পথে কথা হয় পুরান ঢাকার নারিন্দার বাসিন্দা আবুল কাওসারের সঙ্গে। তিনি সম্ভাবনার কথা বললেন, ঢাকার মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল শহরে হেয়ার রোড আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ইতিহাস, প্রকৃতি ও নগরের ভারসাম্য এখনো সম্ভব। এই রাস্তা আমাদের শেখায়, সংযোগ শুধু রাস্তার কাজ নয়, বরং তা হতে পারে সংস্কৃতি, স্মৃতি ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধন। হেয়ার রোডে এলে মনে হয়, জীবনটা শুধু পথচলা নয়। খুঁজে খুঁজে পথ বের করারও আরেক নাম।