লালবাগ কেল্লার মূল ফটকের উল্টো দিকে গড়ে উঠেছে অনেক রেস্তোরাঁ। এমনই একটি রেস্তোরাঁ হচ্ছে ‘কেল্লা কাবাব’। এই রেস্তোরাঁয় বসে উপভোগ করা যায় লালবাগ কেল্লার সৌন্দর্য
লালবাগ কেল্লার মূল ফটকের উল্টো দিকে গড়ে উঠেছে অনেক রেস্তোরাঁ। এমনই একটি রেস্তোরাঁ হচ্ছে ‘কেল্লা কাবাব’। এই রেস্তোরাঁয় বসে উপভোগ করা যায় লালবাগ কেল্লার সৌন্দর্য

লালবাগ কেল্লা

ঐতিহ্যের সান্নিধ্যে রসনাবিলাস

  • লালবাগ কেল্লা রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে।

  • কেল্লায় প্রবেশের টিকিটের মূল্য ১০ টাকা।

  • কেল্লার পাশের রেস্তোরাঁগুলোতে ১৯০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে নানা রকম কাবাব পাওয়া যায়।

লালবাগের কথা এলেই মনে পড়ে মোগল আমলের দুর্গের কথা। ঢাকা শহরের পরিচিতি স্মারক হয়ে আছে বিখ্যাত এই মোগল স্থাপত্য। ঢাকায় যাঁরা বেড়াতে আসেন, দর্শনীয় স্থান হিসেবে তাঁদের অন্যতম গন্তব্য থাকে লালবাগের কেল্লা। ঢাকার বাসিন্দারাও ব্যস্ত জীবনযাত্রার ক্লান্তি ও অবসাদ ঘোচাতে ছুটিছাটায় অনিন্দ্য স্থাপত্যশৈলী ও মোগল আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শনটি দেখতে যান।

বেড়ানোর পাশাপাশি লালবাগের কেল্লার আশপাশে রসনাবিলাসেরও ব্যবস্থা আছে। কেল্লা–সংলগ্ন লালবাগ সড়কের উত্তর প্রান্তে গড়ে উঠেছে সারি সারি হোটেল ও রেস্তোরাঁ। এসব ভোজনালয়ে রয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হরেক রকমের কাবাব, তন্দুরি, নেহারি, তেহারি, বিরিয়ানি, পিৎজা, পাস্তা, বার্গার বা থাই চায়নিজের বৈচিত্র্যময় সম্ভার।

লালবাগে বেড়াতে এলে কেল্লায় প্রবেশ না করেও পাখির চোখে বিশাল স্থাপনাটি দেখার সুযোগ পাবেন লালবাগ রোডের ছাদ রেস্তোরাঁগুলোর বদৌলতে। এখানে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদে করা হয়েছে নান্দনিক সাজসজ্জার রেস্তোরাঁ। দিনের শুরুতে, মধ্যদুপুরে বা কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে এসব ছাদ রেস্তোরাঁয় বসে কাবাব, তন্দুরি, বিরিয়ানি, তেহারির স্বাদ নিতে নিতে সবুজ উদ্যানের মধে৵ মোগল স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।

বেড়ানোর পাশাপাশি লালবাগ কেল্লার আশপাশে রসনাবিলাসেরও ব্যবস্থা আছে। কেল্লাসংলগ্ন স্থানে গড়ে উঠেছে সারি সারি হোটেল ও রেস্তোরাঁ।
লালবাগে বেড়াতে এলে কেল্লায় প্রবেশ না করেও পাখির চোখে বিশাল স্থাপনাটি দেখার সুযোগ পাবেন লালবাগ রোডের ছাদ রেস্তোরাঁগুলোর বদৌলতে

কেল্লায় বেড়ানো

লালবাগ কেল্লাটি অসম্পূর্ণ। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজম শাহ ঢাকায় সুবাদার হয়ে এসে বুড়িগঙ্গা নদীর কোলে একটি সামরিক দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১৬৭৮ সালে। তিনি দুর্গের পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ ও দুর্গের মাঝখানে দরবার ভবন নির্মাণ করেছিলেন। শাহজাদা আজম খুব বেশি দিন ঢাকায় ছিলেন না। দুর্গ নির্মাণ শুরুর বছরখানেক পরেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব নিতে সম্রাট তাঁকে দিল্লিতে তলব করেন। এতে লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।

পরে নবাব শায়েস্তা খান ১৬৮০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সুবেদারির দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন। এ সময় তিনি কেল্লার ভেতরে দরবার ভবনে থেকেই শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। সুবেদার অসমাপ্ত কেল্লার নির্মাণকাজেও হাত দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তাঁর প্রিয় কন্যা পরী বিবি ইন্তেকাল করেন। কেল্লার ভেতরেই দরবার ভবন বরাবর পশ্চিম পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। পরী বিবির সঙ্গে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক করা ছিল। শোকে মুহ্যমান সুবাদার শায়েস্তা খান অনিন্দ্যসুন্দর এক সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন কন্যা পরী বিবির কবরের ওপর। পরী বিবির সমাধির মতো কষ্টিপাথর ও মার্বেল পাথরের অলংকৃত এমন নান্দনিক স্থাপনা দেশে আর দ্বিতীয়টি নেই।

শায়েস্তা খান কন্যার সমাধিসৌধ নির্মাণ করলেও লালবাগ দুর্গের নির্মাণকাজ করতে আগ্রহী হননি। তিনি ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত লালবাগ দুর্গে অবস্থান করেই সুবাদারির দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন। অবসর নিয়ে আগ্রা ফিরে যাওয়ার সময় সুবাদার তাঁর উত্তরসূরিদের দুর্গের মালিকানা দিয়ে যান। লালবাগ কেল্লা এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রত্নসম্পদ। দর্শনার্থীরা রোববার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিন এখানে বেড়াতে আসতে পারেন।

কেল্লার অদূরেই রেস্তোরাঁ

বেড়াতে এসে রসনাবিলাসের সুযোগের কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। লালবাগ রোড ঘুরে দেখা গেল, সড়কটিতে ছোট–বড় অর্ধশতাধিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। মোগল স্থাপত্য দেখতে এসে মোগলাইয়ের স্বাদ নিতে চাইলে সে ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনি দেশি খাবার, ফাস্টফুড, থাই-চায়নিজ কিংবা হালকা খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া শরবত–লাচ্ছিতে চুমুক দিয়ে তপ্ত দিনে প্রাণ ঠান্ডা করে নিতেও পারবেন কেল্লার দর্শনার্থীরা।

রসনাবিলাসের সঙ্গে কেল্লার দৃশ্য উপভোগের ব্যবস্থা আছে কেল্লায় প্রবেশপথের ঠিক বিপরীত পাশের বহুতল ভবনগুলোর ছাদ রেস্তোরাঁয়। বেশ কয়েকটি ছাদ রেস্তোরাঁ রয়েছে। ‘কেল্লা কাবাব’ রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক শেখ আহাদ জানান, এখানে মালাই কাবাব, রেশমি কাবাব, শামি কাবাব, শাহি মুরগি কাবাব, মাছের কাবাবসহ অনেক রকম কাবাব পাওয়া যায়। দাম ১৯০ থেকে ৪০০ টাকা। এ ছাড়া এখানে ক্যাটল ক্যাফে, শর্মা হাউস, দামস্ক, পিৎজা কিং, বিগ স্টার—এমন অনেক রেস্তোরাঁয় পাওয়া যাবে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার।

পুরান ঢাকার বিখ্যাত কাবাবের স্বাদ পাওয়া যাবে কেল্লার পূর্ব প্রান্তের মোড়ের পাশেই মোগল কাবাবে। এখানে আছে মুরগি, গরু ও খাসির মাংসের হরেক রকমের কাবাব ও তন্দুরি। ব্যবস্থাপক নাঈম হোসেন জানান, তাঁদের কাবাবের দোকান খোলে বিকেল থেকে। চিকেন ও বিফ চাপ, বটি, শিক, জালি, রেশমি, টিক্কাসহ অনেক রকম কাবাব পাওয়া যায় এখানে। এ ছাড়া ঝালফ্রাই, মাংস ও মগজ ভুনার সঙ্গে ক্রেতাদের পছন্দ অনুসারে তন্দুরি ও রুমালি রুটি পরিবেশন করা হয়। কাবাবের দাম ১১০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।

পুরান ঢাকার খুব জনপ্রিয় খাবার নেহারি। ‘নেহারি-তেহারি’ নামের একটি বিশাল রেস্তোরাঁ আছে কেল্লার পশ্চিম মোড়ে। ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁরা সকালে নাশতার সঙ্গে ‘খাসির পায়া’ পরিবেশন করেন। প্রতি বাটি ১৪০ টাকা আর গরুর নেহারি পাওয়া যায় সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। স্পেশাল নেহারি প্রতি বাটি ২৮০ টাকা, সিঙ্গেল বাটি ১৮০ টাকা। গরুর তেহারির প্লেট ২৯০ টাকা। গত বুধবার দুপুরে এখানে তেহারি খেতে এসেছিলেন মিরপুরের মো. কবির হোসেন। তিনি একটি মুঠোফোন কোম্পানির গাড়ির চালক। তাঁদের অফিসের ব্যবস্থাপনায় একদল অতিথিকে নিয়ে লালবাগ কেল্লা দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন। দর্শনার্থীরা যখন কেল্লা ভ্রমণ করছিলেন, সেই অবসরে দুপুরের খাবার খেতে কবির হোসেন এসেছিলেন এখানে। তিনি বলেন, মাঝেমধে৵ দর্শনার্থীদের নিয়ে তাঁকে এই কেল্লায় আসতে হয়, তখন এখানে তেহারি খান। এটা তাঁর বেশ পছন্দের।

চায়নিজ বা থাই খাবার যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য লালবাগ রোডে ভূতের বাড়ি, ডার্ক হাউস এমন বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। ভূতের বাড়ির ব্যবস্থাপক মো. রিয়াজ জানান, কেল্লার দর্শনার্থীরই তাঁদের এখানে প্রধান ক্রেতা। ‘জুস আপ’ নামের পানীয়র দোকানের মালিক তন্ময় হোসেন জানান, তাঁরা লাচ্ছি, শরবত থেকে অনেক রকমের ফলের রস, ঠান্ডা কফি, চকলেট ও ক্যারামেল কফি, নানা ধরনের মিল্কশেক বিক্রি করেন ৩৫ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। ‘লাজিজো’তে পাওয়া যায় হালকা খাবার।

এ ছাড়া পুরান ঢাকার জনপ্রিয় নান্না ও হানিফ বিরিয়ানির শাখাও রয়েছে এখানে। তবে লালবাগ এলাকার রয়েল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট খুব জনপ্রিয়। কেল্লার পূর্ব দিকের মোড় পেরিয়ে হরনাথ ঘোষ রোড মোড়েই এই দোতলা হোটেল। ভাত–ভর্তা ও মাছের ঝোলের মতো দেশি খাবার থেকে খিচুড়ি, কাচ্চি ও চিকেন বিরিয়ানি, তেহারি, কাবাব, তন্দুরি, চায়নিজ—সবই পাওয়া যায় এখানে। পছন্দমতো খাবার নেওয়া যায়; আবার সেট মেনুও আছে। সকালের নাশতা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত প্রতিদিন বহুলোক এখানে খেতে আসেন। পার্সেল দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে।

লালবাগ কেল্লার খানিকটা উত্তরে গোরেশহীদ মাজার এলাকাতেও বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে হোটেল জান্নাত, কাচ্চি ডিলাক্স এগুলো বেশ জনপ্রিয়। মুখের স্বাদের বদল আর রুটিনমাফিক দিন কাটানোর ফাঁকে খানিকটা বৈচিত্র্য যোগ করতে আগ্রহীরা আসতে পারেন ইতিহাসখ্যাত লালবাগ কেল্লায়।