
বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে গাছ-বাঁশ-ছনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটি স্কুল। নাম ‘পাওমুম থারক্লা’। ম্রো ভাষায় যার অর্থ ‘ফুলের কলি ফোটাতে হবে’। এই স্কুলের শিশুরা কেউ কোনো দিন লামার বাইরে যায়নি। অভিভাবকদের অবস্থাও প্রায় একই। পাহাড়ের আড়ালে থাকা এই শিশুরাই এবার প্রথমবারের মতো ঢাকায় এল; তাদের নিজেদের গল্প বলতে, শোনাতে।
আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ২৬ জন ম্রো শিশু ও ম্রো জনগোষ্ঠীর ৪০ জনকে নিয়ে উদ্বোধন হয়েছে ‘পাওমুম পার্বণ ২০২৫’ উৎসব। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এ উৎসব চলবে।
আয়োজকেরা জানান, লামায় অবস্থিত পাওমুম থারক্লা একটি সম্প্রদায়নির্ভর বিদ্যালয়, যা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ম্রো ভাষা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং শিশুশিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। উৎসবে অংশ নেওয়া অনেক শিশুর জন্য এটিই পাহাড়ের বাইরে তাদের জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। ২০১৬ সালে ৩ শিশুকে নিয়ে শুরু হওয়া স্কুলটিতে এখন পড়ছে ৬৮ জন ম্রো শিশু। ৩০ জন থাকে হোস্টেলে, যা বান্দরবান জেলা পরিষদের সহায়তায় তৈরি হয়েছে। চারজন শিক্ষক আছেন; আর একজন বাবুর্চি রয়েছেন শিশুদের খাবারের দায়িত্বে। স্কুলটিতে শিশুরা নিজের ভাষা শেখার পাশাপাশি বাংলা, গণিত ও ইংরেজি শেখে।
আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ম্রো সম্প্রদায়ের পরিবেশনায় ছিল ‘প্লুং’ বাঁশি এবং শিশুদের নাচ। এর পাশাপাশি প্রদর্শন করা হচ্ছে ম্রো শিশুদের হাতে গাঁথা পুঁতির মালা, আঁকা ছবি। ম্রো শিশুরা জানায়, প্রথমবার ঢাকায় আসা এবং ঢাকার মানুষদের হাতে উপহার হিসেবে কিছু তুলে দিতে তাদের এই উদ্যোগ। বড়দের তৈরি করা ঐতিহ্যবাহী নকশার কম্বল, বাঁশের কাজসহ নানা হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে রয়েছে। এ ছাড়া আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়েছে ম্রোদের জীবনযাপনের স্থিরচিত্র।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাওমুম থারক্লা স্কুলের জমিদাতা চংকত ম্রো তাঁর নিজের ভাষায় বলেন, বান্দরবানের জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে ম্রোরা সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল। তারা বাঁশ কেটে, গাছ কেটে জীবনধারণ করত। এখন তাদের সন্তানেরা পড়ালেখা শিখছে। তারাও এগিয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক ড্যানিয়েল আফজালুর রহমান, পাওমুম থারক্লা স্কুলের দুই প্রতিষ্ঠাতা শাহারিয়ার পারভেজ ও উথোয়াইয়ই মারমা। এ সময় স্কুলটির উদ্যোক্তারা বলেন, লামার দুর্গম এলাকার শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পায় না। পাওমুম থারক্লার শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই পরিবারের প্রথম সন্তান, যারা স্কুলে যাচ্ছে। এখানে শিশুরা বিনা মূল্যে পড়াশোনা করে।
উল্লেখ্য, সপ্তাহজুড়ে উৎসবে শিশুদের তৈরি শিল্পকর্ম, বাঁশের কারুশিল্প, ফটোগ্রাফি, বুননের প্রদর্শনী, শর্ট ফিল্ম ও লাইভ পারফরম্যান্স, যেমন ম্রো নৃত্য, গান ও ঐতিহ্যবাহী প্লাং বাঁশি উপস্থাপন করা হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন কর্মশালা, গাইডেড ট্যুর ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।