
‘অসৎ কবীর বলে, তোমার মনে ঈশ্বরের
বাস। মনের চোখে তারে খোঁজ। কর্মের
হিসাব দাও। প্রেমই ঈশ্বর। ঈশ্বরই প্রেম।’
১৯৭৯ সালে বোর্ডে টেম্পারা মাধ্যমে আঁকা ‘মসজিদ, লালন ও মন্দির’ শীর্ষক চিত্রকর্মে এ কথা লিখেছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী শহিদ কবীর। ফকির লালন সাঁইয়ের গানের পঙ্ক্তি এবং নিজের কথা চিত্রপটে অকপটে একসঙ্গে লিখে অসাম্প্রদায়িক-সহজিয়া-ঐশ্বরিক বিশ্বাস ও জীবনের কথাই বলেছেন শিল্পী।
এ চিত্রে বাদ্যযন্ত্র সারিন্দাকে এক পাশে রেখে মসজিদ ও মন্দিরের মাঝে সাদা রঙের অচেনা পাখি ও দাঁড়িপাল্লা হাতে এঁকেছেন এক প্রতীকী ফকির লালন সাঁই। গত শতকের সত্তরের দশকে শহিদ কবীরের আঁকা লালন পর্বের চিত্রমালা বাংলার মানুষের ইহলৌকিকতার প্রেক্ষাপটে অপার্থিব ও পারমার্থিকতার মনোজগতের অনন্য দলিল।
এই চিত্রকর্ম ছাড়াও ১৯৭৮ সালে আঁকা ‘সাদা ঘোড়ার উপরে লালন’ এবং ১৯৭৯ সালে আঁকা ‘কালের যাত্রামঞ্চ’ চিত্রকর্ম নিলাম করতে যাচ্ছে বিশ্বখ্যাত শিল্পকর্ম নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সদবি’স। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নিলাম হতে যাচ্ছে শিল্পী শহিদ কবীরের লালন পর্বের চিত্রকর্ম।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বেলা দুইটায় শুরু হতে যাচ্ছে ‘দক্ষিণ এশীয় আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা’র এই নিলাম। শহিদ কবীরের এ চিত্রকর্মগুলো সদবি’সে নিলামের জন্য এসেছে স্পেনের এক সংগ্রাহকের কাছ থেকে। সদবি’সের পক্ষ থেকে নাম প্রকাশ না করা এই সংগ্রাহক ঢাকায় ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া শিল্পী শহিদ কবীরের দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী থেকে তিনটি চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেছিলেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা এই চিত্রকর্মগুলো ৪৫ বছর পর আবার জনসমক্ষে এসেছে। নিলাম হতে যাওয়া এ চিত্রকর্মগুলোর আনুমানিক মূল্য ধার্য হয়েছে ৭ হাজার ৫০০ থেকে ৯ হাজার ৫০০ পাউন্ড।
নিলাম হতে যাওয়া শহিদ কবীরের এই তিন চিত্রকর্ম সম্পর্কে সদবি’সের ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয় শিল্পকলা বিভাগের ‘কো-ওয়ার্ল্ডওয়াইড হেড’ মঞ্জরি সিহারে সুতিন ই–মেইলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এই মাস্টারওয়ার্কগুলো সুফি সাধক লালনের প্রতি একটি উদ্যাপন। লালন ছিলেন ১৮-১৯ শতকের একজন রহস্যবাদী, যিনি সব পটভূমির মানুষকে স্বাগত জানাতেন এবং জাতি, শ্রেণি ও ধর্মীয় বিভাজন প্রত্যাখ্যান করতেন।’ তিনি জানান, চিত্রগুলোর উপরিভাগ শহিদ কবীরের স্বকীয় দৃশ্যভাষাকে উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়ে তোলে, যেখানে পাঠ্য, প্রতীক, প্রতিকৃতি এবং রূপের মাধ্যমে এই তিন চিত্রে একটি আখ্যান চিত্রিত হয়েছে।
স্থানীয় বা লোকশিল্পের অনুপ্রেরণা, বাংলার সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন এবং পশ্চিমা-আন্তর্জাতিক শিল্পচর্চার সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে পাওয়া যায় বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার নিজস্ব চরিত্র। এর ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে শহিদ কবীর নিজ শিল্পভাষা খুঁজেছিলেন পরম মমতায় বানানো নকশিকাঁথায়। নিয়ম করে সকালে রেডিওতে শুনতেন ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে ফকির লালন সাঁইয়ের গান। এই গান ও সুর শহীদ কবীরের সৃজনজগৎ নিল আরেকটি পর্যায়ে।
এ ছাড়া ধারণা করা যায়, পুঁথিচিত্র ও মোগল ক্ষুদ্র চিত্রশিল্প (মিনিয়েচার) থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন শহিদ কবীর। এরই ধারাবাহিকতায় লালনদর্শন, ভাব, শব্দ, সংকেত, প্রতীক ও পঙ্ক্তিতে শহিদ কবীর বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার পরম্পরায় মেনে আঁকলেন লালন পর্বের চিত্রমালা। গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এসব চিত্রমালা তিনি আঁকতে শুরু করেছিলেন। মুখের ভাষা ও বিশ্বাসের ভাষায় গড়ে উঠল শহিদ কবীরের একেকটি চিত্রকর্ম।
লালন পর্বের এই চিত্রমালা ১৯৮০ সালে শিল্পী শহিদ কবীরের দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশ কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসের (জয়নুল গ্যালারি, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রদর্শনী। তখন তিনি এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। পরিবারসহ থাকতেন আজিমপুরে পার্টি হাউসে ছোট্ট একটি ঘরে। লালন পর্বের চিত্রমালা ১০ বর্গফুটের এই ঘরে বসেই এঁকেছিলেন।
১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আঁকা মোট ৩২ চিত্রকর্ম এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। ১৯৮০ সালের ৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে। দারুণভাবে আলোড়ন তৈরি করা এ প্রদর্শনীর আগে শিল্পীর লালন পর্বের শুরুর পর্যায়ে আঁকা চিত্রকর্ম ১৯৭৬ সালে পেয়েছিল দ্বিতীয় জাতীয় নবীন চিত্র প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
এই চিত্রকর্মে অপটু হাতে শিল্পীর নিজের বাড়ির ঠিকানা লিখে সহজ জ্যামিতিক আয়োজনে টেম্পেরা মাধ্যমে আঁকলেন বইঠা হাতে নৌকায় দাঁড়ানো এক মাঝি। স্পষ্ট করে ছবির নিচে লিখেছিলেন, ‘ছোট নৌকা, মাছ নাই। মানুষ মানুষকে মারতে চায়।’ আধ্যাত্মিকতার নানা রূপ ছাড়াও লালন পর্বে শিল্পী শহিদ কবীর হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদী।
ওই ধারাবাহিকতায় সদবি’সে নিলাম হতে যাওয়া ১৯৭৯ সালের ‘কালের যাত্রামঞ্চ’ চিত্রকর্মে তরবারি ধরা এক রাজার পাশে প্রায় মৃত মানুষের দেহ এঁকে শিল্পী শহিদ কবীর তুলি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘এ মঞ্চে তুমি রাজা, আমি অপরাধী। আমার তরবারি নাই, কিন্তু ক্ষুধার্ত ধারাল শক্ত নখ আছে আমার। অসৎ কবীর।’
শহিদ কবীরের লালন পর্বের এই একক চিত্র প্রদর্শনী সম্পর্কে ১৯৮০ সালের ১২ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছিলেন, ‘লালন প্রতিবাদ করেছেন জীবনের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে, উন্মোচন করেছেন জীবনের পর্যায়ে পর্যায়ে গ্রন্থিত ভণ্ডামি। সে জন্য তিনি বাঙালি লোকজ জীবন অধিকার করেছেন, রূপান্তরিত হয়েছেন প্রতীকে। শহিদ কবীর লালনের এই প্রতীকী সত্তার বিভিন্ন স্তর নিয়ে তাঁর বক্তব্য তৈরি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, তাঁর সময়, তাঁর সম্বন্ধে।’
শহিদ কবীরের তিনটি চিত্রকর্ম বিষয়ে সদবি’সকে সহযোগিতা করা কানাডার সাউথ এশিয়ান গ্যালারি অব আর্ট এবং সাগা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আলী আদিল খানের সঙ্গে ই–মেইলে যোগাযোগ হয়। তিনি লেখেন, ‘শহিদ কবীরের লালনকেন্দ্রিক চিত্রকর্মগুলো তাঁর প্রাথমিক শৈল্পিক বিকাশের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। তাঁর মনোযোগ ও অনুপ্রেরণা হলেন লালন শাহ, যিনি বাঙালি লোকসংস্কৃতির একজন শ্রদ্ধেয় সুফি সাধক ও ব্যক্তিত্ব। দক্ষিণ এশিয়ায় কবীর, বুল্লে শাহ এবং আমির খসরুর মতো ব্যক্তিত্বদের আধ্যাত্মিক গানের অনুরূপ তাঁর গানগুলোর জন্য তিনি অত্যন্ত প্রশংসিত ও স্মরণীয়।’
শহীদ কবিরের লালন পর্বের চিত্রকর্ম মূলত গানভিত্তিক। দক্ষিণ এশিয়ার আরও চিত্রশিল্পী তাঁদের কাজের মাধ্যমে গান ও কবিতা ফুটিয়ে তুলেছেন উল্লেখ করে আলী আদিল খান বলেন, আবদুর রহমান চুঘতাই গালিব ও ইকবালের কবিতা; সাদেকাইন ও এম এফ হুসেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা নিয়ে কাজ করেছেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও লেখালেখি উপমহাদেশের বাইরের অনেক শিল্পীকে প্রভাবিত করেছে। এঁদের মধ্যে যামিনী রায় উল্লেখযোগ্য।
আলী আদিল খান আরও বলেন, লালন পর্বের চিত্রমালার মাধ্যমে অচিন পাখির ডাক শুনেছিলেন শহিদ কবীর। সময়–সুযোগমতো গিয়েছিলেন ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়ায়। লালন পর্বের ছবি আঁকতে বেছে নিয়েছেন বাউল-সাধক ঘরানার জীবন। ফকির লালন সাঁইয়ের কথার অনুপ্রেরণায় লিখেছেন আপন জীবন থেকে পাওয়া উপলব্ধির সারমর্ম। তাই লালন–বিষয়ক প্রদর্শনীর ক্যাটালগে ‘প্রার্থনা’ শিরোনামের লেখায় শহিদ কবীর লিখেছেন, ‘আমি দীন, কী দিয়ে শুধিব এ ঋণ।/ আমার সামান্য কর্ম হাতে নত হলাম,/ বেলা শেষে আপন করে নিয়ো আমায়।’
লন্ডনে সদবি’সের ‘দক্ষিণ এশীয় আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা’র এবারের আয়োজনে শহিদ কবীর ছাড়াও নিলাম হচ্ছে জয়নুল আবেদিন, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশীদ চৌধুরী ও কালিদাস কর্মকারের চিত্রকর্ম। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার শিল্পীদের চিত্রকর্ম থাকছে এবারের নিলামে।
দক্ষিণ এশীয় শিল্পকলার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সদবি’সের ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয় শিল্পকলা বিভাগের কো-ওয়ার্ল্ডওয়াইড হেড মঞ্জরি সিহারে সুতিন বলেন, ‘বাংলাদেশি শিল্পীরা দেশের ইতিহাস ও প্রাণবন্ত সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে ফিগারেটিভ ও বিমূর্ত উভয় ধরনের স্মারকতুল্য দৃশ্যভাষা তৈরি করেছেন। জয়নুল আবেদিন সাধারণ মানুষের জীবন ও দুর্দশার বিশ্বস্ত চিত্রায়ণ তাঁকে শিল্পাচার্য উপাধিতে ভূষিত করেছে। মোহাম্মদ কিবরিয়া ও আমিনুল ইসলামের বিমূর্ত চিত্রকর্ম বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের উজ্জ্বল রংগুলো ধারণ করে। এ ছাড়া সফিউদ্দিন আহমেদ ও কামরুল হাসানও চিত্রকলার নতুন ভাষা নিয়ে এসেছেন, যা বাংলাদেশি মানুষের সুন্দর পরিচিতি তুলে ধরে।’
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সদবি’সের লন্ডন কেন্দ্রে ‘দক্ষিণ এশীয় আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা’র নিলামে বিক্রি হয়েছিল জয়নুল আবেদিনের ১৯৭০ সালে কাগজে আঁকা জ্যামিতিধর্মী একটি চিত্রকর্ম। এই চিত্রকর্মের আনুমানিক মূল্য ধার্য করা হয়েছিল ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার পাউন্ড। তবে বিক্রি হয়েছে ৫ লাখ ১৬ হাজার পাউন্ডে (৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা)। এটি এখন পর্যন্ত বিশ্ব নিলামের রেকর্ডে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্মের সর্বোচ্চ মূল্য।
উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো ‘দক্ষিণ এশীয় আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা’র বিশেষায়িত নিলাম আয়োজন করে ১৭৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত শিল্প নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সদবি’স। সদবি’স জানিয়েছে, চলতি বছরের মার্চে নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠানটির ‘দক্ষিণ এশীয় আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা’র নিলামে মোট ১ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে। যা চিত্রকর্মের নির্ধারণ করা আনুমানিক মূল্যের সর্বনিম্ন অনুমানের চেয়ে ৩ গুণের বেশি। নিলামে এসব চিত্রকর্মের বিক্রির হার সাড়ে ৯৫ শতাংশ। এ ছাড়া ৮৪ শতাংশ চিত্রকর্ম প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ অনুমান মূল্যের চেয়েও বিক্রি হয়েছে বেশি দামে।
আশফাকুর রহমান: লেখক ও সাংবাদিক
ই–মেইল: ashfak@gmail.com