মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধপ্রস্তুতি, ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধপ্রস্তুতি, ১৯৭১

অনারারি ক্যাপ্টেন এম এ ওহাব

ফুলবাড়ী অভিযান

অনারারি ক্যাপ্টেন এম এ ওহাবের জন্ম ১৯৪৩ সালে খুলনা জেলার বুজবুনিয়া গ্রামে। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে সৈয়দপুর ইউনিটের ‘এ’ কোম্পানির ২ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার থাকা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে লড়াই করেন। তাঁর যুদ্ধের স্মৃতির ভান্ডার বিশাল। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে এখানে থাকল তাঁর ফুলবাড়ী অভিযানের বৃত্তান্ত।

ফুলবাড়ী অভিযান ছিল আমার প্রথম সম্মুখ লড়াই। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পটভূমি হিসেবে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। সেটা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈয়দপুর হেডকোয়ার্টারে একটা কোম্পানিতে কর্মরত। শীতকালীন প্রশিক্ষণ চলছিল সুন্দরবনে। সেখানে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম। ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের সময় পাাকিস্তানিরা আমাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করত বিভিন্নভাবে। রোল কলের সময় একদিন একটা করে ফরম আমাদের দেওয়া হলো। রাজনৈতিক ধরনের প্রশ্ন ছিল সে ফরমে। যেমন আমরা কাকে সমর্থন করি ইত্যাদি। বাঙালিরা তাদের বুঝিয়ে দিল যে আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি। ইতিমধ্যে কী হলো, আমাকে কমান্ড পোস্টে ডেকে নিয়ে গেল। বলা হলো যে প্রশিক্ষণ বাদ, এখন আমাকে ভারত সীমান্তে গোয়েন্দা-দায়িত্ব পালন করতে হবে, রিপোর্ট করতে হবে দিনাজপুর ইপিআর হেডকোয়ার্টারে। কিছু চীনা অস্ত্রশস্ত্র, ম্যাপ, ওয়্যারলেস, একটা জিপ ইত্যাদি দিয়ে আমাকে পাঠানো হলো। আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে ইপিআর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে সেনাবাহিনীর পোশাক বদলে ইপিআরের পোশাক পরিয়ে দিলেন। কারণ, সীমান্ত রক্ষার কাজ করে ইপিআর।

অনারারি ক্যাপ্টেন এম এ ওহাব

১০–১২ দিনের মতো আমি খানপুর বর্ডার আউট পোস্টে দায়িত্ব পালন করি। এরপরে হঠাৎ একদিন বলা হলো, গুটিয়ে নাও, আজ রাতেই সৈয়দপুর ফিরে যাও। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ সেটা, আমি সৈয়দপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ফিরে এলাম। একদিন সন্ধ্যায় আমরা জানতে পেলাম, ঢাকার কাছে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে পাঞ্জাবি সৈন্যদের বেশ বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। পাঞ্জাবিরা বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গিয়েছিল, তখন সংঘর্ষ বেধে যায়। এর আগে ঢাকার দিকে বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবর আমরা পাচ্ছিলাম। জয়দেবপুরের ঘটনার পরই আমাদের খবরের কাগজ পড়া, রেডিও শোনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। এরপর সৈয়দপুরেও আমার দেখতে পেলাম ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের আক্রমণের পাঁয়তারা করছে।

একই সঙ্গে পাকিস্তানিরা ভারতের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। আমাকে আবার সীমান্তে ইপিআরের কাজে পাঠানো হলো। বর্ডার আউটপোস্টগুলোতে আমি ডিউটি করতে লাগলাম। এদিকে ২৬ মার্চ ঘনিয়ে আসছে। বাসুদেবপুর বর্ডার আউটপোস্টে একটা অস্ত্রাগার ছিল। সেটার দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার শুকুর আলী। তিনি সেখানকার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, যেহেতু এখানে পাঞ্জাবি আছে, পাঠান আছে, সেহেতু এই অস্ত্রাগার আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সেটা করার জন্য আমার অস্ত্রগুলো ওদের সঙ্গে রাখা হলো এবং বলা হলো এগুলো রক্ষা করতে হবে। আমি রাতে প্যাট্রলিং শেষ করে এসে দেখি, কিসের প্রটেকশন দেওয়া, বাঙালিরা সব গিয়ে খেলাধুলা করছে। আমি তখন ওদের ওপর রাগ করে আমার অস্ত্রগুলো বের করে নিয়ে এলাম নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণে। ওরাও তখন একটু সতর্ক হয়ে গেল। পরদিন সকালে প্যাট্রলিংেয় গেছি। এর মধ্যে খবর পেলাম যে আটাপাড়া বর্ডার আউটপোস্টে, যেটা হিলি বর্ডার আউটপোস্টের পাশেই, সেখানে পাঞ্জাবি সৈন্যদের সঙ্গে বাঙালি সৈন্যদের সংঘর্ষ হয়েছে, কয়েকজন মারাও গেছে। এটা সম্ভবত ২৫ বা ২৬ মার্চ। এই অবস্থা প্রায় সবখানে। তখন পাকিস্তানি বাহিনী সিদ্ধান্ত নিল যে সীমান্ত এখন রাখো, দেশের ভেতরের অবস্থাই খারাপ, ভেতরটা সামলাও। আমি তখন বর্ডার আউটপোস্ট ছেড়ে গাড়ি নিয়ে ভেতরের দিকে আসতে লাগলাম। মোহার নামের একটা গ্রামে এসে এক গোয়ালে গাড়ি রেখে সেখানে ওয়্যারলেস সেট করেছি, তারপর আবার বর্ডার আউটপোস্টের দিকে যাচ্ছি। দেখি, সেখানেও পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বাঙালি সৈন্যদের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। পাঞ্জাবিরা তাড়া খেয়ে ভারতের দিকে ছুটে গেছে, ভারতের বিএসএফ তাদের পাকড়াও করে নিয়ে গেছে।

তখনই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ২৫ বা ২৬ মার্চ চলে এসেছে। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে সেসব তো আমাদের ভাবার সময় নেই। আমাদের বাস্তব পরিস্থিতিই আমাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। এরপর আমরা পরিকল্পিতভাবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিলাম।

প্রথম লড়াই: ফুলবাড়ী

দিনাজপুরের বাসুদেবপুর বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি) থাকাকালেই যুদ্ধের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। কারণ, সেখানে ২৬ মার্চের আগেই পাঞ্জাবি সৈন্যদের সঙ্গে বাঙালি সৈন্যদের সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। আমরা দেখলাম আর বসে থাকার সময় নেই। আক্রমণ চালাতে হবে।

বাসুদেবপুর বিওপি থেকে আটটি বিওপির ইপিআরের বাঙালি লোকজনদের খবর পাঠানো হলো। বলা হলো, তারা যেন সবাই চরকাই কলেজ এলাকায় ওই দিনই সন্ধ্যার মধ্যে জড়ো হয়। সেটা সম্ভবত মার্চের ২৬ বা ২৭ তারিখ। চরকাই কলেজ এলাকায় ইপিআরের আটটি বিওপি থেকে আসা সৈন্যরা জড়ো হলো। আমিসহ আর্মির লোক ছিলাম মাত্র ছয়জন।

আমরা প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলাম, ফুলবাড়ী অভিমুখে এগোব। কারণ, ফুলবাড়ী যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট। উত্তরে বা দক্ষিণে, পূর্বে বা পশ্চিমে কোথাও যেতে হলে ফুলবাড়ী অতিক্রম করেই যেতে হতো। ফুলবাড়ী চরকাই থেকে উত্তর দিকে চার-পাঁচ মাইল দূরে। এরই মধ্যে আমরা সংবাদ পেলাম যে দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বাঙালি সৈন্যদের ওপর পাঞ্জাবি পাঠান বিহারিরা আক্রমণ করেছে। সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। তখন আমাদের মধ্যে একদল বলল যে না, ফুলবাড়ী নয়, আগে আমরা দিনাজপুর কুঠিবাড়ির দিকে যাব। আ​মি বললাম, সেটা ঠিক হবে না। কারণ, ফুলবাড়ী খুবই ভাইটাল পয়েন্ট, ফুলবাড়ী নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিল। একদল ফুলবাড়ীকে ডানে রেখে বাঁ পাশ দিয়ে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হলো। আমি বাকি দল নিয়ে ফুলবাড়ীর দিকে অগ্রসর হলাম। আমার দলে প্রায় ৪০ বা ৪৫ জন। আমাদের হাতে অস্ত্র বলতে পুরোনো মডেলের মার্ক ফোর রাইফেল, একটা করে গুলি বেরোয়। আমার হাতে অবশ্য অটোমেটিক চীনা সাবমেশিনগান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে তিন-চারজন ছিল, তাদের হাতে সেমিঅটোমেটিক রাইফেল।

ফুলবাড়ীর দিকে এগোচ্ছি। ফুলবাড়ী পৌঁছাতে মাইলখানেক বাকি; তখন দেখি দলে দলে মানুষ ছুটে পালাচ্ছে। কী ব্যাপার? তারা বলল, ফুলবাড়ীতে পাঞ্জাবিরা এসে পড়েছে, তারা সেখানে পজিশন নিয়েছে। আমরা তখন বেশি করে বুঝলাম যে ফুলবাড়ী ছেড়ে দিয়ে আমাদের যাওয়া উচিত হবে না।

তখন ভোর চারটার মতো। ফুলবাড়ীর দিকে এগোচ্ছি। ফুলবাড়ী পৌঁছাতে মাইলখানেক বাকি; তখন দেখি দলে দলে মানুষ ছুটে পালাচ্ছে। কী ব্যাপার? তারা বলল, ফুলবাড়ীতে পাঞ্জাবিরা এসে পড়েছে, তারা সেখানে পজিশন নিয়েছে। আমরা তখন বেশি করে বুঝলাম যে ফুলবাড়ী ছেড়ে দিয়ে আমাদের যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু তখনো রাত। চারদিকে অন্ধকার। আমরা থেমে পড়লাম। অন্ধকারে শত্রুর অবস্থান নির্ণয় করা যাবে না। ভোরের আলোর অপেক্ষায় থাকতে হবে। ভোরের আলো যখন একটু একটু করে ফুটছে, তখন আমি আমার লোকজনকে বললাম, তোমরা এখানে থাকো, আমি গিয়ে শত্রুবাহিনীর অবস্থান দেখে আসার চেষ্টা করি। আমি লুঙ্গি পরা অবস্থায়, গায়ে একটা পাঞ্জাবি। নদীর পাড় ধ​ের আমি ফুলবাড়ী ব্রিজে গেলাম। ব্রিজ পার হয়ে সুজাপুর কলেজের মাঠ অতিক্রম করে গেলাম। আরও একটু এগোবার পরে সাধারণ লোকজন বলল যে হাসপাতালে পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা পজিশন নিয়ে আছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে এ কথা শুনলাম, সেখান থেকে হাসপাতালের একটা কোনা দেখা যায়। আমার মনে হলো, সেদিকে আর এগোনো উচিত হবে না। আমি আমার আগের অবস্থানে ফিরে এলাম। সেখানে আমি আমার বাহিনীর লোকদের বললাম যে ওখানে পাঞ্জাবিরা আছে, তারা আর্মির লোক, নিশ্চয়ই তারা সেখানে ট্যাকটিক্যালি ডেপ্লয়েড হয়ে আছে। আমাদের এভাবে ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না। অগ্রাভিযান ভিত্তিতে এগোতে হবে। তারপর আমি আমার লোকদের সেকশনে ভাগ করে ফেললাম, স্কোয়াড সামনে রাখলাম, পুরো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে। এভাবে আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম। কাঁচা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে আমরা ফুলবাড়ী বাজার পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। তখন পর্যন্ত আমরা কোনো বাধার সম্মুখীন হলাম না। তখন সকাল সাতটা–সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। আমরা ব্রিজের দিকে এগোচ্ছি, তখন একটা ট্রাক দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেল। সেটা দেখার পর আমার লোকজন আনন্দে হইচই করে দৌড়ে গিয়ে গাড়িটাতে উঠে পড়ে। তারা মনে করেছে যে পাকিস্তানি বাহিনী ফুলবাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এই আনন্দে আমাদের ট্যাকটিক্যাল মুভমেন্ট ভেঙে যায়। এলোমেলোভাবে ১০-১৫ গজ এগোেনার পর হঠাৎ করে হাসপাতালের দিক থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ হতে শুরু হলো আমাদের ওপর। গাড়িতে যারা ছিল, তারা গড়িয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। বাঁ দিকে যারা আত্মরক্ষার পজিশন নিয়েছে, তাদের নিয়ে আমি কাছেই একটা ইটের ভাটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এখন ব্রিজের উভয় পাড়ে আমাদের লোক, সুজাপুর কলেজের দিকে আমাদের লোক। ইটের ভাটার ভেতর থেকে দেখতে পেলাম চার-পাঁচজন পাকিস্তানি ৈসন্য একটি জিপে চড়ে হাসপাতালের দিক থেকে এসে ব্রিজ অতিক্রম করছে। আমার হাতে ছিল চায়নিজ সাবমেশিনগান। ওটা দিয়ে তাদের দিকে গুলি চালালাম। তাদের জিপের চাকা বার্স্ট করে গাড়ি থেমে গেল। জিপ থেকে পাকিস্তানি সেনারা নেমে ব্রিজের ওপর থেকে আমাদের দিকে প্রচণ্ড গুলি ছুড়তে লাগল। তারা খুব সুবিধাজনক অবস্থান থেকে আমাদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল। ওরা ওপ​ের, আমরা নিচে। ওদের হাতে অটোমেটিক মেশিনগান। আমাদের অধিকাংশ ইপিআর জওয়ানের হাতে পুরোনো মডেলের মার্ক ফোর রাইফেল। শুধু আমার হাতে একটি অটোমেটিক রাইফেল আর দু–তিনজনের হাতে সেমিঅটো। ব্রিজের ওপর থেকে চার-পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা আমাদের দিকে প্রচণ্ড গুলি ছুড়ে চলেছে। তাদের পেছন থেকেও প্রচণ্ড গুলি আসছিল। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এভাবে একটানা যুদ্ধ চলতে থাকল। হঠাৎ আমাদের কাছে সংবাদ এল, আমাদের সাহায্য করার জন্য দিনাজপুর কুঠিবাড়ি থেকে মর্টার আর মেশিনগান পাঠানো হচ্ছে। আর যে গ্রুপটা আমাদের বাঁ দিক দিয়ে কুঠিবাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তারা আমাদের যুদ্ধের খবর পেয়ে ফিরে এদিকে এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যার কিছু আগে আমাদের মেশিনগান, মর্টার, ম্যানপাওয়ার এসে গেল বেশ পরিমাণে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলতে থাকল উভয় পক্ষে। কিন্তু নিজ নিজ অবস্থান থেকেই, কেউ অগ্রসর হচ্ছে না। এক শ–দেড় শ গজের ভেতরে গোলাগুলি চলছে। মাগরিবের একটু পরে হঠাৎ ওদের দিকের গুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা তখন দৌড়ে গিয়ে ব্রিজের ওপর উঠলাম। দেখলাম চারজন পাকিস্তানি সেনা মরে পড়ে আছে, ওদের হাতে মেশিনগান ধরা। একজনকে আহত অবস্থায় ধরা হলো। একটা চায়নিজ হেভি মেশিনগান, তিনটা চায়নিজ এলএমজি আর বেশ কিছু গোলাবারুদ আমরা সেখানে পেলাম। গাড়িটাও নেওয়া হলো। ব্রিজ পার হয়ে আমরা প্রায় এক মাইল পর্যন্ত এগোলাম। কিন্তু তাদের কোনো চিহ্ন নেই। সাধারণ লোকজন বলল যে পাঞ্জাবি সৈন্যরা পালিয়ে গেছে। ফুলবাড়ীতে তারা আর কেউ নেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা আমাদের সঙ্গে গুলিবিনিময় করেছে। যেই সন্ধ্যা হয়েছে, ব্রিজের ওপরে চারজন মারা গেছে, তখনই ওরা ভেগে গেছে।

এই হচ্ছে আমার প্রথম সম্মুখযুদ্ধ, সেখানে আমাদের পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি বলতে মাত্র একজন গুলি লেগে আহত হয়েছিল। মার্চের ২৭ বা ২৮ তারিখের ঘটনা।

(সংক্ষেপিত)

‘রক্তঝরা সেই মার্চ ’৭১: সম্মুখযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বয়ান’,  প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০০১