Thank you for trying Sticky AMP!!

সংক্রমণ বাড়ার দায় সাধারণ মানুষের নয়

জাতিসংঘের সংস্থা ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’ (ডব্লিউএফপি) বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য ২০ কোটি ডলার তহবিল জোগানোর জন্য দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি ১৫ মে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর গত ৫০ বছরের অগ্রগতি উল্টে যাওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে। সংস্থাটির মুখপাত্র এলিজাবেথ বার্য়াস জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেছেন, লকডাউন ও চলাচলে বাধানিষেধের কারণে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ (রিকশাচালক, দিনমজুর প্রভৃতি দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ) নিজেদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন না। ডব্লিউএফপির প্রকল্পে অর্থায়ন হলে গ্রামীণ ও শহুরে দিনমজুর পরিবারগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। সংস্থাটি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আগামী ছয় মাসের প্রয়োজন মেটাতে আরও ১২ কোটি ডলার চেয়েছে।

‘ইউএননিউজ’-এ প্রকাশিত এই খবর বাংলাদেশের কোনো সংবাদমাধ্যমে আমার নজরে পড়েনি। খবরটি পড়ে আমার মনে পড়ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পের ‘সবচেয়ে গরিব’ মালিকদের কথা। যে মালিকেরা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারছেন না, তাঁদের ‘গরিব’ না বলে উপায় কী! এমনকি সরকার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য কম সুদে বিশেষ ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরও তাঁরা শ্রমিকদের বেতনের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের বেশি দিতে অক্ষম বলে ত্রিপক্ষীয় সালিস বৈঠকে জানিয়েছেন। তাঁরা ঋণ নিলে শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে পারবেন না, এমন শর্ত থাকা সত্ত্বেও কয়েক লাখ শ্রমিক ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন বলে ট্রেড ইউনিয়নগুলো বলছে। সরকারি আদেশে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় তাঁরা সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে দু–দুবার লাখ লাখ শ্রমিককে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আসতে বাধ্য করেছেন। ‘গরিব’ না হলে কি তাঁরা এই শ্রমিকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারতেন না?

আর কিছুটা গরিবি তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছেন, যখন তাঁদের সমিতি, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বণিক সভা বিজিএমইএর সভাপতি ডব্লিউএফপির কাছে চিঠি লিখে শ্রমিকদের জন্য খাদ্য সাহায্য চেয়েছেন। তিনি এ কথা জানিয়েছেন মাসখানেক আগেই। দেশের শ্রমিকেরা অভুক্ত থাকবে, এ কথা বলে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন যদি এ রকম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্য চাইত, তাহলে সেই ইউনিয়নের নেতাদের বিরুদ্ধে এত দিনে কত ধরনের মামলা হতো বলা মুশকিল। আর যদি বিএনপি কিংবা গণফোরাম অথবা নাগরিক ঐক্যের মতো রাজনৈতিক দল এমন কাজ করত, তাহলে সরকারকে অকার্যকর প্রমাণের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে নির্ঘাত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ে বিচার সম্পন্ন হতো।

২.
কদিন পরেই ঈদুল ফিতর। মহামারির মধ্যে ঈদ স্বাভাবিক সময়ের মতো হওয়ার কথা নয়। তবু খবরের কাগজে বা টেলিভিশনের পর্দায় ছবি দেখে বিভ্রম হতে পারে। দেশের প্রধান বিপণিকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকলেও ছোট ও মাঝারি আকারের অনেক দোকানে এবং ফুটপাতে অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ঢাকার প্রধান বিপণিকেন্দ্রগুলো সুযোগ পেয়েও দরজা খোলেনি। তাদের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। দেশের বৃহত্তম ফ্যাশন চেইন আড়ংও একই সিদ্ধান্ত নিলে এখন সীমিত সংখ্যায় যাঁরা দোকান খুলেছেন, তাঁরাও সাহস করতেন কি না, সেই প্রশ্ন তোলাই যায়। তবে প্রশ্নটা সেখানে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশই যখন মহামারির মধ্যে দোকান খুলতে নারাজ, তখন ঈদের জন্য সীমিত পরিসরে দোকানপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিতে হবে? আবার সেই সিদ্ধান্তকেই কোথাও উল্টে দিচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসন, কোথাও স্থানীয় রাজনীতিকেরা।

কলকারখানা চালুর মাধ্যমে অর্থনীতি সচল করার বেলায়ও ঘটেছে একই কাণ্ড। শিল্প–বাণিজ্যের শীর্ষস্থানীয় অনেকেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের আগে সবকিছু খুলে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। রপ্তানি আদেশের শর্তপূরণের অজুহাতে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের ঘাপলায় প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়ে প্রথমে নীরবতা, তারপর নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ জারি এবং সপ্তাহ দুয়েকের বিরতির পর আবারও অনুমতি প্রদান।

এখন দফায় দফায় ছুটিও বাড়ছে, আবার জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্বের কথাও বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পোশাকশ্রমিকদের গ্রামে ফেরা এবং আবার ঢাকামুখী হওয়ার ঘটনাগুলোতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে বলেই প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন। এখন দোকানপাট খোলার পরও তিনি একই ধরনের কথা বলেছেন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি এসব সিদ্ধান্তের কোনো কোনোটির কথা জানতেন না বলেও দাবি করেছেন। সংকট ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার এই স্বীকারোক্তির জন্য অবশ্য তাঁর ধন্যবাদ পাওয়ার কথা। কিন্তু দেশে কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো বিরোধী দলও তো নেই।

মানুষ ঘরে থাকছে না বলেও কেউ কেউ সংক্রমণ বিস্তারের দোষটা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছেন। সরকারের নীতি ও নির্দেশনাগুলোর মধ্যে গরমিল ও সমন্বয়হীনতায় যে হযবরল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, তার দায় কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের নয়। সংক্রমণ যখন সীমিত ছিল, তখন সবকিছু আলগা করে দেওয়ার পর তা ছড়িয়ে পড়ার পর জনজীবনকে সীমিত করার চেষ্টা কষ্টকর ও দীর্ঘায়িত হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন তো মানুষের ঘরের মজুত ফুরিয়েছে, সঞ্চয়ও শেষ। ষাট শতাংশ মানুষের জীবিকা যেখানে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষ অবরুদ্ধ রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হলে তঁাদের নিন্দা করার কিছু নেই।

৩.
মহামারির মতো দুর্যোগে জনসাধারণ তাঁদের ওপরই ভরসা রাখে, যাঁদের বিশ্বাস করতে পারে। তাই তারা অতি ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের পরামর্শ-নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। আর অসুস্থ হয়ে পড়লে ভরসা ডাক্তার-নার্স-হাসপাতাল। অথচ সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত, সেগুলোর বাস্তবায়ন বা হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তনের কথা ভাবুন। কিংবা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়ানো ও করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেন ঘাটতিসহ নানা ধরনের সংকটের খবর পাওয়ার পর সরকারের ওপর জনসাধারণের আস্থার লেশমাত্র আর থাকে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

মহামারির সূত্রপাত যেখানে, সেই চীন থেকে সংক্রমণ প্রথমে ছড়িয়েছে এশীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে। তারপর ইউরোপ ও আমেরিকায়। দক্ষিণ এশিয়ায় তা পৌঁছেছে ইউরোপের পরে। ফলে অন্যদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ আমাদের ছিল অনেক বেশি। কিন্তু আমরা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পথে হেঁটেছি। প্রথমে বিপদের মাত্রা ও গুরুত্ব বুঝিনি অথবা তা উপেক্ষা করেছি। ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো বলে মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাবি সংখ্যাগত দিক থেকে এখনো ঠিক। তবে তাঁদের এই আত্মতৃপ্তি কতটা অসার, তা প্রতিবেশীদের সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়। নেপাল, ভুটান কিংবা ভিয়েতনাম কত কম সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে, তার তুলনা টানা মোটেও অন্যায় হবে না। ভিয়েতনামের কাছে বাজার হারানোর কথা বলেই আমাদের পোশাক কারখানাগুলো খুলতে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ওই সব দেশে রাজনীতি নির্বাসিত হয়নি। বরং, রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থাহীনতা ও অসন্তোষের কথা প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে কার্পণ্যের কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন সুশাসনের অভাবের কথা। স্বল্প বরাদ্দের অর্থেরও যে নয়ছয় হওয়ার চিত্র সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে, তার নিরিখে মানতেই হয় যে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব প্রকট। মহামারির সময়ে চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী, বিশেষত মাস্ক নিয়ে কেলেঙ্কারিও সেই অব্যবস্থা, অনিয়মের সাক্ষ্য বহন করে। রাজনীতি এবং জবাবদিহিহীনতায় সেই সুশাসনের প্রশ্ন কার্যত অর্থহীন।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক