'সিস্টেম অ্যাপ্রোচ' প্রয়োগে করোনামুক্তি ঘটুক

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

আমরা কেন গভীর করোনা সমস্যায় পড়লাম, এ বিষয়ে ‘সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ নিয়ে দু-চারটি কথা না বললেই নয়। একটি আরবীয় উপকথার মাধ্যমে সিস্টেম অ্যাপ্রোচ ভালো বোঝা যাবে। উপকথাটি অনেকেরই পরিচিত। অনেকে এটিকে একটি কৌতুক ভাবেন। আসলে কৌতুক নয়, কয়েক শ বছর আগে সৃষ্ট উপকথাটির সারমর্ম এই যে সিস্টেম অ্যাপ্রোচ না নিলে সমস্যা কমে না, বাড়ে।

উপকথাটি এ রকম—একবার শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পেটের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ঘোষণা করল। হাত উত্তেজিত, ‘আমিই দুনিয়ার যত কাজকর্ম সব করি, পেট কিছুই করে না, অথচ সব খাবার সে-ই পায়।’ পদদ্বয়েরও একই অভিযোগ, ‘আমরা হাঁটা, চলাফেরা করতে দিই। কিন্তু কী লাভ! খাবার তো যায় পেটে।’ মাথা খেপে গেছে, ‘বুদ্ধিসুদ্ধি সব আমার। পেটের তো বুদ্ধিই নেই।’ একইভাবে চোখ, কান, নাক—সব অঙ্গ বিদ্রোহ করল। সিদ্ধান্ত হলো, আজ থেকে পেটের সেবায় তারা কেউ আর নিজেদের উৎসর্গ করবে না। হাত-পা নড়াচড়া বন্ধ করল। চোখ মুদিত থাকল। কান শব্দের জন্য কপাট বন্ধ করে দিল। মস্তক ভাবনাচিন্তা বাদ দিল। কয়েক দিন যেতে না যেতেই হস্ত-পদযুগল টের পেল, তারা শুকিয়ে যাচ্ছে। টলোমলো কাঁপছে। মাথা মগজশূন্য বোধ করতে থাকল। চোখ নিজেকেই মেলতে পারছে না। খালি শর্ষে ফুল দেখা যায়। কানের ভেতর ভনভন শব্দ। যে পেটের বিরুদ্ধে ধর্মঘট, সে কিন্তু দিব্যি আছে। তার প্রায় কিছুই হয়নি। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো তাদের ভুল বুঝতে পারল। পেটের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, ‘বুঝলাম, আমরা সবাই মিলেই একটি সিস্টেম। একটি অন্যটির সঙ্গে অসহযোগিতা করলে আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা নিজেরাই।’

নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, জার্মানি, থাইল্যান্ড করোনা নিরাময়ে সিস্টেম অ্যাপ্রোচ নিয়েছিল। ফলাফল, করোনা তাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারেনি। নিউজিল্যান্ড নিজেদের করোনামুক্ত ঘোষণা করেছে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বায়ন ও বিনোদনকামী বিদেশিতে সয়লাব থাইল্যান্ডে হাজার হাজার করোনা মৃত্যুতেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু সেখানে মাত্র ৫৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। গত দুই সপ্তাহে সেখানে নতুন সংক্রমণ নেই। কারণ, দেশটি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কারফিউ দিয়েছিল। ভিয়েতনামও অনেকটা একই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছে।

বাংলাদেশের জন্য সহজতম কার্যকর সিস্টেম অ্যাপ্রোচ কী হতে পারত? শুরুতে একজন শনাক্ত হওয়ামাত্রই দুই বা তিন সপ্তাহের জন্য কারফিউ দিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। বাংলাদেশ ক্ষুদ্রায়তনের দেশ। এটি একটি বিশেষ সুবিধা এবং সুযোগ। কারফিউ খুব সহজেই কার্যকর করা যেত। কারফিউর মাধ্যমে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সীমিত ভূ-ভাগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সুযোগ অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। সামরিক বাহিনী, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমলাতন্ত্র, চিকিৎসাসেবা কর্তৃপক্ষ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরব্য উপকথাটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতোই। যেহেতু কারফিউ হলেও হতো জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ সুরক্ষার জন্যই, জনগণের পূর্ণ সমর্থনসহ সহযোগিতা, সহায়তাও পাওয়া যেত। জনবিক্ষোভ বা জনবিশৃঙ্খলা দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে যে রকম কারফিউ হয়, করোনা-কারফিউটি কোনোভাবেই সে রকম কিছু হতো না। এটিকে আসলে দেশজুড়ে সামষ্টিক পর্যায়ের একটি সামগ্রিক কোয়ারেন্টিন বলাই সঠিক হতো।

কেন কারফিউ দরকার ছিল? কারণ, করোনার বিস্তার ঘটে জ্যামিতিক হারে। পরজীবী গুল্মের মতো। ফলদ বৃক্ষে পরজীবী গুল্মের আক্রমণটিকে নজরে আসামাত্রই ঠেকিয়ে দিতে হয়। সামান্য গাফিলতি দেখালে সকালে দেখা এক ফুট জায়গার পরজীবী আক্রমণ সন্ধ্যা নাগাদ অর্ধেক গাছে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আর নির্মূল করা যায় না। কেটেকুটে সাফ করে ফেললেও মূল কাণ্ডের ক্ষুদ্র টুকরা থেকে আবারও জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে। পরজীবী চরিত্রের করোনাও ১ থেকে ১০ জন, ১০ থেকে ১০০, ১০০ থেকে ১ হাজার জনে ছড়াতে সামান্যই সময় নেয়। সে জন্য কঠিন ও কষ্টসাধ্য পদ্ধতি হলেও কারফিউর মাধ্যমে কমিউনিটি সংক্রমণের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া দরকার ছিল।

একদিন যখন দেখলাম টিভির এক টক শোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বাস্থ্য সমাজবিজ্ঞানীর কারফিউ দেওয়ায় পরামর্শ আইইডিসিআরের একজন ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আতঙ্কিত হয়ে প্রমাদ গুনেছিলাম। তিনি ‘অর্থনীতি’, ‘বাস্তবতা’, ‘জীবন-জীবিকা’ প্রসঙ্গে বেশি বলতে থাকায় আতঙ্ক বেড়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল, তিনি রোগতত্ত্ব, জীবাণুর বিস্তার, নতুন নতুন রূপ নেওয়া ইত্যাদি যত ভালো বুঝবেন, চিলমারীর প্রত্যন্ত গ্রামে হাঁস-মুরগি পালনে সহায়তা দানকারী একজন সমাজবিজ্ঞানপড়ুয়া এনজিওকর্মীর সমানভাবে তৃণমূলের সমাজ-সম্পর্কের উত্থান-পতন তো বুঝবেন না। আবার সেই তৃণমূলের এনজিওকর্মীও আইইডিসিআরে রোগ নির্ণয়ের কিছুই পারবেন না। ফলে তাঁরও এই বিষয়ে প্রগলভ হওয়া অনুচিত। কারণ, প্রতিটি পেশারই নিজস্ব বিশেষত্ব ও সৌন্দর্য আছে। সিস্টেম অ্যাপ্রোচে সেগুলোর বিজ্ঞানসম্মত সমন্বয় হয়। যাঁরা যে কাজে পারদর্শী, তাঁদের মেধার সর্বাধিক কার্যকর ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়।

ঘরোয়া পরিবেশেও সিস্টেম অ্যাপ্রোচ রোগপ্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। কীভাবে? সিস্টেম অ্যাপ্রোচ না থাকার উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। ধরা যাক, একটি ঘরে আটজন মানুষ বাস করেন। আটজনের প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করছেন যে তিনি ছাড়া অন্যরা করোনার বাহক হয়ে থাকতে পারেন। অসুস্থ না হলেও অন্যকে সংক্রমিত করতে পারেন। প্রত্যেকেই একই টেবিলে বসে খাবার খেতে দারুণ অস্বস্তি ও অনীহা বোধ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের কারণে কেউ কাউকে বলছেনও না। তারপর একজন অসুস্থ হলেন। স্বাভাবিক সর্দি-কাশিই মাত্র। তবু সবাই ভীতি-আতঙ্কে অমানবিক আচরণ শুরু করলেন। অনাদরে ও অচিকিৎসায় মারা যাওয়ার পর সন্দিহান স্ত্রী-সন্তানও কাছে ঘেঁষলেন না।

একটি স্বাভাবিক ও মানবিক সমাজ-সম্পর্ককে এ রকম ভয়ানকভাবে কলুষিত করার পেছনে সিস্টেম অ্যাপ্রোচের অনুপস্থিতিই দায়ী। অ্যাপ্রোচটি থাকলে আটজনই সহজলভ্য কিট দিয়ে ঘরে বসেই সংক্রমণ পরীক্ষা করতেন। ‘ফলস পজিটিভ’ হিসেবেও একজন ধরা পড়লে বাকি সাতজন নিশ্চিন্ত। সংক্রমিতকে কড়া কোয়ারেন্টিনে রেখে পরিবারের সদস্যরা সংস্পর্শ এড়িয়ে খাদ্য-পথ্য, সেবা-শুশ্রূষা দিতে পারতেন। যিনি সংক্রমিত, তিনিসহ সবাই অবস্থাটি সম্পর্কে জ্ঞাত বলে মানসিক যন্ত্রণা, অবিশ্বাস, সন্দেহ, সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুই হতো না। ঘরোয়া পরিসর ছাড়িয়ে রাষ্ট্র পরিসরেও সিস্টেম অ্যাপ্রোচ প্রয়োগের একটি দারুণ সুযোগ নিয়ে এসেছিল গণস্বাস্থ্য। প্রশাসনিক জটিলতায় এই সহজলভ্য কিটও জনগণ ব্যবহার করতে পারেনি। দৃশ্যত কমিউনিটি সংক্রমণ এখনো বিধ্বংসী হয়ে ওঠেনি। শেষ চেষ্টা হলেও, শেষ দেউটিও নিবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে এখনো সিস্টেম অ্যাপ্রোচ ব্যবহারের শেষ সুযোগটি রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ, দয়া করে বিষয়টি ভেবে দেখুন।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি। গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি