
সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম ওরফে মিতু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন কামরুল শিকদার ওরফে মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে ১৬৪ ধারায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন পালিয়ে থেকে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। তবে যেদিন মুছা আদালতে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সেদিনই গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন তাঁকে ধরে নেয়।
২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীতে প্রকাশ্য দিনের বেলায় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানমকে। পাঁচ বছর পর আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন বাবুল আক্তার। হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পরই তদন্তে মুছার নাম চলে আসে। বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর সোর্স হিসেবে পরিচিত ছিলেন মুছা। এ হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ দুয়েক পর থেকে এ পাঁচ বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন মুছা।
সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হোসেন মোহাম্মদ রেজার আদালতে জবানবন্দি দেন মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, বাবুল আক্তারের নির্দেশে মুছা মাহমুদাকে হত্যা করেন বলে জবানবন্দি দিয়েছেন মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার। তিনি বলেছেন, ২০১৬ সালের ২২ জুন আদালতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন মুছা। কিন্তু ওই দিনই নগরীর কাঠগড়ের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি হাতকড়া পরিয়ে মুছাকে ধরে নিয়ে যায়। মুছার পাসপোর্ট তাঁদের কাছে রয়েছে। মুছা দেশ ছেড়ে পালাননি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে পান্না বলেছেন, তিনি সরাসরি মুছার কাছে জানতে চেয়েছিলেন মাহমুদা হত্যায় জড়িত কি না। জবাবে মুছা তাঁকে বলেন, বাবুল আক্তার তাঁকে খুন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি রাজি হননি। তবে লোক দিয়েছিলেন। এ কাজে সহায়তা না করলে বাবুল তাঁকে ফাঁসিয়ে দেবেন, এমন আশঙ্কা করছিলেন মুছা।
পান্না আক্তার বলেছেন, যেদিন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খুন হন, সেদিন তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরের কালামিয়া বাজারের বাসায় ছিলেন। তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি মুছাকে বাসায় রেখে রাঙ্গুনিয়ায় বাবার বাসায় চলে আসেন। হঠাৎ শুনতে পান তাঁদের বাড়িতে পুলিশ গেছে। নানা জায়গায় সাদাপোশাকে পুলিশ মুছার খোঁজ করছে। এর মধ্যে মুছা তাঁদের রাঙ্গুনিয়ার বাসায় চলে আসেন। মুছা একাধিক ফোন ব্যবহার করতেন। একবার একটা ফোন পান্নার কাছে রেখে তিনি বেরিয়েছিলেন। এ সময় টিঅ্যান্ডটি নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ওই ব্যক্তি বলেন, মুছা যেন সাবধানে থাকে। পরে তিনি জানতে পারেন, ওই ব্যক্তি বাবুল আক্তার।
কেন তাঁকে পুলিশ খুঁজছে? কেনই-বা ফোন করে তাঁকে সাবধানে থাকতে বলা হচ্ছে—এসব প্রশ্ন মুছাকে করেছিলেন পান্না আক্তার। মুছা বিষয়টি এড়িয়ে যান। এর মধ্যে মাহমুদা হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি খুঁজতে পুলিশ রাউজান পৌঁছায়। এ সময় মুছার নম্বরে বাবুল আক্তার ফোন করেন। পান্না তখন মুছার পাশেই বসা ছিলেন। তিনি ওই প্রান্তের কথা পরিষ্কার শুনতে পাননি। তবে মুছাকে বলতে শোনেন, ‘আমার পরিবারের কিছু হলে আমি কিন্তু মুখ খুলব স্যার।’ পান্নার ধারণা, কথোপকথনটি হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৮ বা ১৯ জুন।
এর আগে গত ২৫ মে বাবুলের ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হকের কর্মচারী মোখলেসুর রহমান এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে মোখলেসুর রহমান বলেন, তাঁর মালিক সাইফুলের নির্দেশে তিনি মুছাকে তিন লাখ টাকা পাঠান।
মাহমুদা খানম খুন হওয়ার পর তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে নিজে বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেছিলেন। প্রায় পাঁচ বছর পর গত ১২ মে ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ওই দিনই বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বাবুল এখন কারাগারে আছেন।
স্ত্রী খুন হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার পর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বাবুল আক্তার। পরে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন বলে তাঁর পরিচিতজনেরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।