
প্রায় এক কিলোমিটার যানজট ও আধা কিলোমিটার দীর্ঘ নারী-পুরুষের লাইন ঠেলে পৌঁছাতে হলো চার বছর বয়সী কবিরাজ সাকিব হাসানের বাড়িতে। বাড়ির উঠানে মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কবিরাজ পাঁচ বছরের এক প্রতিবন্ধী শিশুকে মাটিতে চিত করে ফেলে তার বুকের ওপর উঠে নাচানাচি করছে।
শিশুটি যতই আর্তনাদ করছে, কবিরাজের নাচানাচি ততই বাড়ছে। হাসিমুখে গলা চেপে ধরে, মুখে-চোখে চড়-থাপড় মেরে শিশুটির রোগ তাড়াচ্ছে। আট মাস ধরে চিকিৎসার নামে এই প্রতারণা চলছে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার হারোয়া গ্রামে।
শিশু কবিরাজকে পরিচালনা করছে তার বাবা ফরহাদ হাসান, খালু আবদুস সাত্তার, মামা রাজু আহমেদ, স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর হোসেনসহ সাতজনের একটি দল। গত শনিবারও ওই কবিরাজের বাড়িতে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে চিকিৎসা দিতে দেখা যায়।
শনিবার ভোর ছয়টায় সরেজমিনে দেখা যায়, হারোয়া গ্রামে ঢোকার পথে যানজট। গ্রামের সরু আধা পাকা রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য রিকশা, ভ্যান, ভটভটি ও কার-মাইক্রোবাস। এক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের পর রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় পাঁচ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। সারিতে রয়েছেন হিন্দু-মুসলিম সবাই। নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি।
চিকিৎসা নিতে আসা ৫০ জন রোগী জানালেন, পরস্পরের মুখে রোগ ভালো হওয়ার কথা শুনেই তাঁরা প্রথমবারের মতো এসেছেন। তখন কবিরাজ সাকিব হাসান ঘুমাচ্ছে বলে জানালেন তার বাবা ফরহাদ হাসান (৪২)। এর মাঝে দেখা গেল কবিরাজের বাড়ির এক কোণে ড্রামভর্তি পানি। আগন্তুকেরা সঙ্গে নিয়ে আসা বোতলে করে ওই পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন ওষুধ হিসেবে। ঘুমানোর আগে কবিরাজ নাকি ওই পানিতে ‘ফুঁ’ দিয়ে গেছে। বিনিময়ে কারও কাছেই কিছু চাওয়া হচ্ছে না। তবে সবাই ১০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত হাদিয়া দিয়ে যাচ্ছেন।
সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠলে কবিরাজকে কোলে তুলে নিলেন তার বাবা ফরহাদ হাসান। পাশে দাঁড়িয়ে মা রাশেদা বেগম বাতাস করছেন। বাবার কোল থেকে আগন্তুকদের কাউকে হাত দিয়ে, কাউকে পা দিয়ে ছুঁয়ে, আবার কাউকে ফুঁ দিয়ে চিকিৎসা করছে কবিরাজ। বাহ্যিক টিউমারের সমস্যা রয়েছে যাঁদের, তাঁদের টিউমার মুখে কামড়িয়ে দিচ্ছে। দাবি না থাকলেও প্রত্যেকে সাধ্যমতো টাকাপয়সা দিচ্ছেন। কেউ কেউ কবিরাজের জন্য এনেছেন মুরগি ও জামাকাপড়। এসব করতে করতে শিশুটি ক্লান্ত হয়ে একসময় আবার ঘুমিয়ে পড়ল। আবারও অপেক্ষার পালা। দুপুর ১২টার দিকে যখন ঘুম ভাঙল, তখনো সারিবদ্ধভাবে লোকজন চিকিৎসার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। একই পদ্ধতিতে এক ঘণ্টা চিকিৎসার পর শিশুটি আবারও ঘুমিয়ে গেল। আগন্তুকদের পীড়াপীড়িতে স্বজনেরা শিশুটিকে অনেকটা জোর করেই ঝাড়ফুঁক দেওয়াচ্ছিলেন। বিরক্ত হলেও শিশুটি সাড়া না দিয়ে পারছিল না। বিকেল থেকে শুরু হয়ে রাত নয়টা পর্যন্ত একইভাবে চলে তার চিকিৎসা। স্বেচ্ছাসেবক আলাউদ্দিন হোসেন জানালেন, প্রতিদিনই চিকিৎসা চলে। তবে শনিবার ও মঙ্গলবার রোগী বেশি হয়।
ফরহাদ হাসান জানান, তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। সাকিব সবার ছোট। গর্ভে থাকাকালে তার মা স্বপ্নে দেখেছেন ছেলে মস্ত বড় কবিরাজ হবে। সর্বশেষ আট মাস আগে একরাতে পাশের বাড়ির শিশু আরমান অসুস্থ হলে সাকিব নিজে থেকে তাকে ফুঁ দিলে সে তাৎক্ষণিক সুস্থ হয়। এ খবর জানাজানি হলে প্রথমে আশপাশের, পরে বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন চিকিৎসা নিতে আসতে শুরু করেন।
চিকিৎসা নিতে আসা হাজার হাজার মানুষের যাতায়াতের জন্য কয়েক শ পরিবহন ব্যবহৃত হচ্ছে। কবিরাজের বাড়ির আশপাশে শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। খাবারের দোকানের পাশাপাশি শুধু সরিষার তেল বিক্রির জন্য ৩৭টি অস্থায়ী দোকান বসেছে। এ ছাড়া কবিরাজের স্বজনেরা ছাড়াও গ্রামের ১৫ জন লোক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দৈনিক হাজিরায় কাজ করছেন। তাঁদের প্রত্যেককে কবিরাজের বাবা ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে দিয়ে থাকেন।
সাকিবের বাবা ফরহাদ হাসান এক বছর আগেও ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। কিছুদিন ভ্যানে কলা নিয়ে ফেরি করতেন। কোনো রকমে সংসার চলত। গত আট মাসে ছেলের কবিরাজি থেকে উপার্জন কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফরহাদ হাসান জানান, চিকিৎসার জন্য তিনি আগন্তুকদের কাছে কিছুই দাবি করেন না। তবে তাঁরা স্বেচ্ছায় তাঁর ছেলেকে ন্যূনতম ১০ টাকা হাদিয়া দেন। কেউ কেউ বেশি দেন। এ হিসাবে প্রতিদিন তাঁর আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া অনেকে কবিরাজের জন্য জামাকাপড় ও হাঁস-মুরগি নিয়ে আসেন। তবে এ পর্যন্ত কত টাকা তিনি জমিয়েছেন, জানতে চাইলে তার উত্তর দেননি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রঞ্জন কুমার পাল বলেন, এ ধরনের চিকিৎসা সম্পূর্ণ প্রতারণা। জনকল্যাণে বিষয়টি বন্ধ করার জন্য প্রশাসনিকভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, ‘এ ধরনের তৎপরতা বন্ধের জন্য আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ওই শিশুর পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’