হাসতে হাসতে প্রাণ নেয় অজ্ঞান পার্টি!

‘সবই হাতের কাজ। চোখের সামনেই সব হবে। কিচ্ছু টের পাবেন না। ডাব কাটবে, ছিদ্র করবে। তারপর এক হাত ডাবের নিচে রেখে অন্য হাতে থাকা ওষুধ মেশাবে,’ আমুদে গলায় উত্তর দিলেন অজ্ঞান পার্টির সাবেক এক সদস্য। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ডাবের পানি খাইয়ে মানুষকে অজ্ঞান করেন কীভাবে?
অজ্ঞান পার্টির সাবেক এই সদস্য গতকাল প্রথম আলো প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি কীভাবে মানুষকে অজ্ঞান করে জিনিসপত্র নেওয়া হয়, সেসব ঘটনার কথা জানান। তিনি বলেন, অজ্ঞান পার্টির প্রিয় জায়গা বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও লঞ্চঘাট। শহরের ভেতরও অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সময় নিয়ে, সতর্কতার সঙ্গে ‘শিকার’ ধরে। যখন তারা নিশ্চিত হয়, কারও কাছে যথেষ্ট টাকাপয়সা, দামি মুঠোফোন আছে, তখনই তার পিছু নেয়। তাদের শিকার যে রুটের বাসে উঠেছে, অজ্ঞান পার্টির একজন সদস্য প্রথমে তার পাশের বা পেছনের সিটে গিয়ে বসে। তারপর দলের অন্য সদস্যদের কেউ ক্যানভাসার সেজে তার পণ্যের প্রচারের বক্তৃতা শুরু করে। দাবি করা হয়, তার এই খাদ্যপণ্য উত্তেজক এবং খুবই ফলদায়ী। এ সময় ওই দলের যে সদস্য বাসযাত্রীর পাশে বসে, সেও আগে ওই খাবার কিনে খেয়েছে এবং ফল পেয়েছে বলে জানায়; বাস থেকেই কিনেছিল এবং ওই ব্যক্তির কাছ থেকেই। সে নানাভাবে ওই পণ্যের গুণগান শুরু করে এবং একপর্যায়ে বাসযাত্রীকে খাইয়ে দেয়।
অজ্ঞান পার্টির সাবেক ওই সদস্য ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে এক ব্যক্তির অজ্ঞান হওয়ার গল্প শোনান। অজ্ঞান পার্টির সদস্য বাসস্টেশনে শিকার ঠিক করে তার পাশের আসনের টিকিট কাটে। তারপর চৌদ্দগ্রামে বাস থামলে তাকে সঙ্গে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করে। এক ফাঁকে পানিতে ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই ব্যক্তির যা ছিল, সব নিয়ে চম্পট দেয়।
পুলিশ নিয়মিত অজ্ঞান পার্টির লোকজন ধরছে, তবু কমছে না কেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অজ্ঞান পার্টির লোকজন তখনই ধরা পড়ে, যখন তাদের নিজেদের মধ্যে টাকাপয়সার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গোলমাল হয়। বনিবনা না হলে দলেরই কেউ একজন পুলিশের তথ্যদাতাকে খবর দিয়ে দেয়। কারাগারে গেলেও কিছুদিন পর দলের লোকজন তাদের ছাড়িয়ে আনে। তারা বরং জেলে গিয়ে আরও কিছু লোককে দলে ভেড়ায়। অজ্ঞান পার্টির সাবেক এই সদস্য নিজেও একবার জেলে গিয়েছিলেন বলে জানান।
পুলিশ জানায়, এই অপরাধে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু এই অপরাধ প্রমাণ করা খুবই কঠিন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর ঘটনার শিকার লোকজন আর মামলা করে না।
অজ্ঞান পার্টির সাবেক এই সদস্য যতটা হালকাভাবে গল্প করে গেলেন, সমস্যাটা ততটা ভয়ংকর। অজ্ঞান পার্টির ওই সদস্য নিজেও সমস্যাটা বোঝেন। তিনি মনে করেন, এ ধরনের অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন এ ধরনের রোগী আসেন ২০-২৫ জন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার মঈনুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করা হয়। কখনো কখনো মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য যে মাংসপেশিগুলো কাজ করে, সেগুলো অবশ হয়ে যায়। মানুষ আর শ্বাস নিতে পারে না। মারা যায়। যদি ঘুমের ওষুধের পরিমাণ কম হয়, তাহলেও সাত-আট ঘণ্টার আগে আর রোগী স্বাভাবিক হতে পারে না। রোগী আসা মাত্রই প্রথমেই তাদের পাকস্থলী থেকে সব খাবার বের করে নেওয়া হয়। তারপরও অনেকের মধ্যে সমস্যা থেকে যায়। কেউ কেউ ঝিমাতে থাকে, কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে যায়। সারা জীবন ভয় তাড়া করে।
বছর পাঁচেক আগে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন নুরুল ইসলাম। খুব গরম পড়েছিল। তিনি শুক্রাবাদ থেকে বেইলি রোডে যাওয়ার জন্য টিকিট কেটে কাউন্টারে দাঁড়ান। এক ডাব বিক্রেতার থেকে ডাব কিনে খান। বাসেও ওঠেন। তারপর নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাব খেতে খুব ভালোবাসতাম। ভুলেও এখন বাইরে ডাব খাই না। পাঁচ বছর ধরে কী ঘটেছিল মনে করার চেষ্টা করি, কিছুতেই মনে পড়ে না।’