
সাড়ে চার বছর আগে খুলনার দিঘলিয়ার দেয়াড়া দেবনগর গ্রাম থেকে চার সদস্যের ঋণগ্রস্ত পরিবারটি ঢাকার ইস্কাটন এলাকায় আসে। গৃহকর্তা আলী আকবর মজুমদার রিকশা চালানো শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী সিজু বেগম বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ নেন। তাঁদের দুই সন্তান সিয়াম মজুমদার ও সেজান মজুমদার ইস্কাটন এলাকাতেই দুটি মোটরপার্টস ডেকোরেশনের দোকানে কাজ নেন। পরিবারের সবাই মিলে চেষ্টা করছিলেন ঋণমুক্ত হওয়ার।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যার পর নিউ ইস্কাটনে ফ্লাইওভার থেকে ছোড়া ককটেলের বিস্ফোরণে আলী আকবর ও সিজু বেগম দম্পতির বড় ছেলে সিয়ামের মৃত্যুতে অসহায় পরিবারটি যেন আরও অসহায় পড়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ইস্কাটনের দুই হাজার গলিতে সিয়ামদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার মা সিজু বেগম বিলাপ করছিলেন। শুধু বলছিলেন, ‘আমি আর ঢাকায় থাকমু না। ঢাকায় আইস্যা সব শেষ হইয়্যা গেল।’ সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সিজু বেগম বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমনেগোর কাছে আমি সূক্ষ্ম বিচার (সুষ্ঠু বিচার) চাই। এই দেশে কেউ সূক্ষ্ম বিচার (সুষ্ঠু বিচার) করে না। আমি বলব, এই সরকার যেন হত্যাকারীদের বের করে বিচার করে। আমি এই বিচার চাই।’
সিয়ামের ছোট ভাই সেজান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জীবিকার সন্ধানে তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন। পরিবারের ঋণ পরিশোধের পর দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন সিয়াম। ভাইয়ের মৃত্যুতে তিনিসহ পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে।
বাসায় যখন সিয়ামের মা ও ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন বাবা আলী আকবর মজুমদার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ছেলের লাশ নেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভাগ্য ফেরাতে ঢাকায় এসে ছেলেকে হারাতে হবে, এমন জানলে তিনি কখনোই ঢাকায় আসতেন না।
এদিকে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গতকাল সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টা ১০ মিনিটের সময় রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের ছোড়া বিস্ফোরক দ্রব্যের আঘাতে সিয়াম মজুমদার (২১) নামে এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। নিহত সিয়াম স্থানীয় একটি মোটরকার ডেকোরেশন দোকানে কাজ করেন এবং ঘটনার সময় তিনি মগবাজার–নিউ ইস্কাটন রোডস্থ কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড কাউন্সিলের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়, ঘটনাটি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক ককটেল সন্ত্রাসেরই অংশ, যার উদ্দেশ্য জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে নিকটস্থ থানা অথবা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর মাধ্যমে পুলিশকে অবহিত করার জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ করা হলো।
ঘটনাস্থলে থাকা চা–দোকানি মো. ফারুক বলেন, ‘ছেলেটা আমার কাছে এসে চা চেয়েছিল। আমি চা বানাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই বিস্ফোরণের শব্দ। দেখি ছেলেটা মাটিতে পড়ে আছে। মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল। ফ্লাইওভার থেকে ককটেল বা বোমা হয়তো ওর মাথায় পড়েছে।’
এ ঘটনায় আজ হাতিরঝিল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার। তবে ঘটনায় জড়িত কাউকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মর্তুজা প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।