
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালত বা ফৌজদারি আদালতে সম্ভব নয়।
আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু।
মানবতাবিরোধী অপরাধে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তাঁর বিচার অন্য কোথাও নয়, শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেই হতে পারবে বলে মন্তব্য করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তাঁর মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালত বা ফৌজদারি আদালতে সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে গতকাল রোববার দুপুরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আশুলিয়ায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ‘ওপেনিং স্টেটমেন্ট’ বা সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তাঁর বক্তব্যের পর ট্রাইব্যুনাল বলেন, ডিফেন্সের উচ্চ পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে হবে নাকি অন্য ট্রাইব্যুনালে হবে—এ রকম একটা প্রশ্ন এসেছে।
এর জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই বিতর্ক অহেতুক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে তাদের (সশস্ত্র বাহিনী) যুক্ত করা হয়েছে। এ সময় আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারা তুলে ধরেন তিনি।
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে আসার পর চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনাল নানা প্রশ্ন করতে পারেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন) ১৯৭৩, এটা মূলত তৈরিই করা হয়েছিল আর্মড ফোর্সের (সশস্ত্র বাহিনী) লোকদের বিচার করার জন্য। পরে অ্যামেন্ড (সংশোধন) করে আরও কিছু উপাদান এতে যুক্ত করা হয়। আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারা উল্লেখ করে তাঁরা ট্রাইব্যুনালকে দেখিয়েছেন, এই আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও বিচার করা যায়। রাষ্ট্রীয় যত বাহিনী আছে, গোয়েন্দা সংস্থা আছে, পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন সেগমেন্টের (শাখা) কথা আলাদাভাবে এ আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যেটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যেটা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে সংঘটিত হবে, সেই অপরাধের দায়ে ডিসিপ্লিন ফোর্সের (সুশৃঙ্খল বাহিনী) বা আর্মড ফোর্সের লোকদের বিচার কেবল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনেই হতে পারবে, অন্য কোথাও নয়। সেটা কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালতে নয়, বাংলাদেশে প্রচলিত যেসব ফৌজদারি আদালত আছে, সেখানেও এটা করা সম্ভব নয়। এ আইনটা (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন) খুবই সুস্পষ্ট।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। এ মামলার বিচার শুরু হয়েছে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
এ মামলার ১৬ আসামির মধ্যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী ও মো. শাহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান ও শেখ আবজালুল হক এবং সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার।
এ মামলার সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, এই বিচার কেবল একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়। এটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি শক্ত বার্তাও। বাংলাদেশ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সে যত শক্তিশালী বা প্রভাবশালী হোক না কেন। এই বিচার হবে একটি ইতিহাস। এটি হবে সেই সব মানুষের আত্মত্যাগের সম্মাননা, যাঁরা ন্যায়বিচারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এই ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ করবেন, বাংলাদেশ একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রাষ্ট্র।
তাজুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশে দেখা গেছে, স্বৈরাচার পালিয়েই শুধু যায়নি, ৩০০ এমপি, মন্ত্রিসভা, পুলিশ বাহিনী, দলীয় নেতা-কর্মী, এমনকি মসজিদের ইমাম ও নিজেদের শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ বলে দাবি করা উচ্চ আদালতের বিচারকেরাও পালিয়েছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় কুষ্টিয়ায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গতকাল বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-১–কে অবহিত করে প্রসিকিউশন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পুলিশের দুই সদস্যসহ তিনজন সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন। এ নিয়ে এই মামলায় জবানবন্দি দিলেন ১৬ জন সাক্ষী।
এই মামলায় আট আসামির মধ্যে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। আর শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম এ মামলায় গ্রেপ্তার আছেন। তাঁদের গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এ মামলায় জবানবন্দিতে পুলিশ সদস্য অজয় ঘোষ বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ভোর চারটার দিকে মিরপুর পুলিশ লাইনস থেকে তাঁরা ২০ জন রওনা দেন। ভোর পাঁচটার দিকে শাহবাগ থানায় আসেন। সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চানখাঁরপুল চৌরাস্তার মোড়ে তাঁরা অবস্থান নেন। সাবেক এডিসি আখতারুল পুলিশ সদস্যদের ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। তিনি গুলি করতে চাননি। তখন সাবেক এডিসি আখতারুল তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন এবং বলেন, ‘সরকারি বেতন-রেশন খাস না, গুলি করবি না কেন?’