
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, গুমের ঘটনায় সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী নয়। তবে তারা গুমের ঘটনা জানত না, এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ, সাবেক একজন সেনাপ্রধান প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে দুজন সেনাসদস্য তাঁর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, তাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে চান না।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়। ঢাকার গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে অংশ নেন কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, সদস্য অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস এবং মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কমিশনের কাছে ২৫৩ জন মানুষের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে, যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুম হয়েছেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এমন ঘটনা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি হাতে গোনা কিছু অবাধ্য কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন অপরাধও হতে পারে না। এটি একটি সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর অস্তিত্ব নির্দেশ করে।
গুমের ঘটনায় বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেকের নাম এসেছে। এ প্রসঙ্গে একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা ডিজিএফআই ও র্যাব যেসব গুম করেছে তার দায়িত্ব নেবে না; এ বিষয়ে কমিশনের বক্তব্য কী? জবাবে কমিশনপ্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ডিজিএফআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটা সঠিক। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকেন। সে হিসেবে ডিজিএফআইয়ের (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) মহাপরিচালক সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। একইভাবে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দাও (এনএসআই) প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ। তিনি বলেন, গুমের ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী দায়ী নয়। কিন্তু ডিজিএফআই, এনএসআই, র্যাবের এডিজিসহ (অতিরিক্ত মহাপরিচালক–অপারেশন্স) বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডিং অফিসারদের বেশির ভাগই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা এ সংস্থাগুলোয় প্রেষণে (ডেপুটেশন) এসেছেন, তাঁদের অনেকে গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ত। মূলত তাঁরা সশস্ত্র বাহিনীরই (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, গুমের ঘটনা সেনাবাহিনী জানত না, এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ, সাবেক একজন সেনাপ্রধান প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, দুজন সেনাসদস্য তাঁর (ওই সেনাপ্রধান) কাছে আশ্রয় চেয়েছেন; তাঁরা এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে চান না। এতেই বোঝা যায়, তারা (সেনাবাহিনী) বিষয়গুলো জানত।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কিছু গুমের ঘটনায় বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেরও নাম এসেছে। ভারতের যারা জড়িত, তাদের বিষয়ে করণীয় কী—এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনপ্রধান বলেন, ‘ওই দেশের যারা জড়িত, তাদের আমরা কিছু করতে পারব না। এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে। তবে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা গোয়েন্দা সংস্থার যারা এই ঘটনাগুলোতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে এখানে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি মইনুল বলেন, গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যাদের শনাক্ত করা গেছে, সবার নাম কমিশন এখনই প্রকাশ করছে না। এর অন্যতম কারণ ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা। ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারগুলো এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। অনেকে এখনো হুমকি পাচ্ছেন। কমিশনের কাছে হুমকি দেওয়ার অডিও রেকর্ডও আছে। ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের।
এ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, এই কমিশন গঠনের পর থেকে যে প্রতিবেদনগুলো দেওয়া হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সন্দেহভাজন অনেকের বিদেশযাত্রা স্থগিত রয়েছে। এর মধ্যে যে মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালে গেছে, সেগুলোতে অনেকের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং সন্দেহভাজন আসামি যেন পালিয়ে না যায়; সেটা বিবেচনায় রেখে অনুসন্ধান চলাকালে পুরো বিষয়টি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনপ্রধান বলেন, ‘গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আগে তিনি কমিশনে এসে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছিল এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল।’ এ সময় কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, ‘তারপরও তিনি (আকবর) নাই হয়ে গেলেন।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গুমসংক্রান্ত অভিযোগগুলোর মধ্য থেকে ১৩১টির বিষয়ে আইন মোতাবেক এফআইআর বা জিডি (এজাহার বা সাধারণ ডায়েরি) করে ভুক্তভোগীদের সন্ধান বা উদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে পাঠানো হয়েছে।
এখন পর্যন্ত কাউকে উদ্ধার করা গেছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, বেশ কিছু তথ্য এসেছে, তবে সেটা এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এ সময় কমিশনের আরেক সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে চার প্রক্রিয়ায় কাজ করছে কমিশন। এক. পুলিশের কাছে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা পাঠিয়ে খুঁজে বের করার জন্য বলা হয়েছে। দুই. বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে কমিশন বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধানে যাচ্ছে। তিন. ভারতের কারাগারে কত বাংলাদেশি বন্দী আছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে; ২০২৩–২৪ সালের আংশিক একটি তালিকা পাওয়া গেছে। সেখানে যে নামগুলো এসেছে, সেগুলো কমিশনের কাছে থাকা নিখোঁজ তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তবে কোনো নাম মেলেনি। এর আগের বছরগুলোর বন্দীদের তালিকাও পাওয়ার চেষ্টা চলছে। চার. বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ‘পুশ ইন’ করার ঘটনা ঘটছে। সেখানে গুমের শিকার কোনো ব্যক্তি আছে কি না, তা–ও দেখা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন জাতিসংঘের সহযোগিতা নেবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনপ্রধান বলেন, ‘জাতিসংঘের স্থানীয় দপ্তর ইতিমধ্যে আমাদের কিছু কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে। তারা আমাদের জন্য ইতিমধ্যে চারজন তথ্য-সংগ্রাহক নিযুক্ত করেছে। তাঁরা এই কমিশনের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।’
কমিশনপ্রধান লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের ছায়াতলে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে।’
এতে মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবী তথা সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হয়েছে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এ প্রক্রিয়ায় তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করেছে। নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দিয়েছে।
কমিশনের লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা গুমের শিকার ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে একটি জঙ্গিবাদ দমন অভিযানে দু-একজন অসাবধানী কর্মকর্তা বা সদস্য কর্তৃক কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে গেছে। বরং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দমনযন্ত্র, যা জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে কমিশনের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, মামলার সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নয়, বরং রাজনৈতিক ও ‘পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর’ ভিত্তিক বিবেচনা কাজ করেছে।
সম্প্রতি জমা দেওয়া কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এক. সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়ে সেগুলো ন্যায়বিচারের মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। দুই. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান সন্ত্রাসবাদ দমন পদ্ধতি (কাউন্টার টেররিজম মেথড) ত্রুটিপূর্ণ। তাই এই ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযুক্ত পদ্ধতি বের করা দরকার।
কমিশনপ্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।