
বাংলাদেশের আইন ও মেটার নিজস্ব নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপনে এবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে বানানো ভিডিও ব্যবহার করা হচ্ছে।
তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে জুয়ার বিজ্ঞাপনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি সমাবেশে দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য বিকৃত করে এআই দিয়ে বানানো ভিডিও এ ধরনের জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে।
কখনো রাজনৈতিক সমাবেশে পরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের, কখনো আদালতের দৃশ্য, হাসপাতালের দৃশ্য, রান্নাঘরে মা-মেয়ের কথোপকথনের দৃশ্য, টাকার অভাবে ঠিকমতো খেতে না পারার ঘটনা দিয়ে এআই ভিডিও বানিয়ে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত ৩১ আগস্ট প্রকাশিত ‘গ্যাম্বলিং অ্যাডস পারসিস্ট অন মেটা, নাউ বুস্টেড বাই এআই ভিডিওস’(মেটাতে জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে, এআই ভিডিও দিয়ে আরও বেশি প্রচার) শীর্ষক গবেষণায় ডিসমিসল্যাব বলেছে, তারা এআই দিয়ে তৈরি ৪৬টি ভিডিও পেয়েছে। অন্তত ১৪টি একাধিক জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে।
জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত এআই ভিডিওতে দেখা যায়, হাসনাত আবদুল্লাহ জনতার সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁর পাশে এনসিপির কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ও চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সমন্বয়কারী মীর আরশাদুল হক রয়েছেন। এআই দিয়ে বানানো হাসনাত আবদুল্লাহর ভিডিওতে তাঁর বক্তব্যে শোনা যাচ্ছে, তিনি চাকরির পাশাপাশি একটি জুয়ার সাইটের মাধ্যমে আয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সাইটটিকে গরিব মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যমও বলছেন।
ভিডিওতে জনতার মধ্য থেকে একটি কণ্ঠে জুয়ার সাইটের নাম উল্লেখ করে বলতে শোনা যায়, ‘ভোটের আগে আয় করুন’। ডিসমিসল্যাবের গবেষণা বলছে, আদতে হাসনাত আবদুল্লাহ এমন কোনো বক্তব্য দেননি এবং জুয়ার প্রচারও করেননি।
ডিসমিসল্যাবের গবেষণা বলছে, গত ২৫ মে চট্টগ্রামে এনসিপির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার পথসভায় অংশ নিয়েছিলেন হাসনাত আবদুল্লাহসহ এনসিপির নেতারা। সে কর্মসূচির একটি সমাবেশের ভিডিও এআই দিয়ে জুয়ার প্রচারণায় ব্যবহার করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে।
মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে জুয়ার বিজ্ঞাপন চালানো হচ্ছে বলে ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় উঠে এসেছে। ২০২৪ সালে তাদের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে জুয়ার বিজ্ঞাপনে প্রতারণামূলকভাবে টেলিভিশনের লোগো বা কনটেন্ট, তারকাদের ছবি সম্পাদনা করে প্রচার করা হয়। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এখনো প্রতিদিন জুয়াসংক্রান্ত বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞাপন মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। অবৈধ এই প্রচারণায় নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে এআই ভিডিও।
ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, গত বছরের ১২ আগস্ট এক দিনেই তারা ১০টি সাধারণ জুয়া ও বেটিং–সম্পর্কিত কিওয়ার্ড ব্যবহার করে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে ৪ হাজার ১৬১টি বিজ্ঞাপন খুঁজে পেয়েছে। এগুলো ২২৫টি পেজ থেকে প্রচার করা হয়েছিল এবং প্রতিটিই জুয়ার অ্যাপে প্রচার করা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্তত ৬২টি পেজ বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত হয়। দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি অ্যাডমিন ভিয়েতনামে ৬০ জন, ভারতে ২০ জন, মালয়েশিয়ায় ১৮ জন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ জন।
বাংলাদেশের আইন ও মেটার নিজস্ব নীতিমালা লঙ্ঘন করেই এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। দেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ আছে। এই আইনে প্রকাশ্যে জুয়া খেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২০২৩ সালের ১১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন, বিশেষ করে খেলার চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যেসব আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে বেটিং ওয়েবসাইটের অর্থ আদান-প্রদান হয়, সেগুলোর গেটওয়ে ও চ্যানেল বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চলতি বছরের মে মাসে জারি হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে অনলাইনে জুয়াখেলা, জুয়ার অ্যাপ বা পোর্টাল তৈরি ও প্রচারণায় অংশ নিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
মেটার তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ যেসব দেশে জুয়াখেলা নিষিদ্ধ, সেসব দেশের ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানো যাবে না। কিন্তু মেটার নিজস্ব নিয়ম লঙ্ঘিত হলেও মেটা এসব বিজ্ঞাপন শনাক্ত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্ল্যাটফর্মগুলোর এ ধরনের আচরণে বোঝা যায়, তারা বাংলাদেশের আইনকে আমলে নিচ্ছে না। শক্তিশালী দেশে কিন্তু তারা আইন ভঙ্গের জন্য জরিমানাসহ নানা জবাবদিহির মুখে পড়ছে।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, সামনে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনও বলছে, এআই, ডিপফেক বড় চ্যালেঞ্জ হবে এবার। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে তাদের এখনই ফ্যাক্ট চেকিংসহ সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি দল গঠন করতে হবে। জুয়া নিষিদ্ধ করলেই হবে না, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে মানুষকে সচেতন করে এ–সংক্রান্ত ভিডিও, বার্তা প্রচার করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে বসতে হবে।