
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সংগঠিত নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত পাচ্ছে পুলিশ।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করে হামলাটি চালানো হয় এবং উদ্দেশ্য ছিল দেশে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করা; হামলার পরপরই পালানোর ছকও কার্যকর করা হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনায় জড়িত হিসেবে এ পর্যন্ত তিনজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাঁদের মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গুলি চালান ছাত্রলীগের নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল, চালক ছিলেন আলমগীর শেখ। ঘটনার আগে হাদিকে অনুসরণকালে (রেকি) এই দুজনের সঙ্গে আরও একজন ছিলেন। তাঁর নাম রুবেল। তিনি আদাবর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী বলে জানা গেছে।
হাদির বিভিন্ন গণসংযোগে ওই তিনজনের একসঙ্গে থাকার ছবিও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই ছবি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। এই তিনজনই আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মনে করছে, হাদিকে হত্যার লক্ষ্যে কয়েক মাস ধরে ছক কষা হচ্ছিল। অন্তত দুই মাস ধরে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিরা তাঁকে অনুসরণ করেছে। তফসিল ঘোষণার পরদিন তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা ছিল অন্যতম লক্ষ্য। ওই ঘটনার দিন রাতে রাজধানীর বাড্ডায় বাসে আগুন ও কয়েকটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ এবং লক্ষ্মীপুরে নির্বাচন অফিসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে ‘শুটার’ (যিনি গুলি করেন) ফয়সল করিম ও আলমগীর শেখ ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের সম্ভাব্য অবস্থান শনাক্ত করে শনিবার রাতেই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে আটক করে ঢাকায় আনা হয়েছে। তাঁরা হলেন সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সঞ্জয় চিসিম জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে দুজন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতে পাচারে সহযোগিতা করেছেন তাঁরা। ওই দুজন ফয়সল ও আলমগীর বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধারণা করছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মনে করছে, হাদিকে হত্যার লক্ষ্যে কয়েক মাস ধরে ছক কষা হচ্ছিল। অন্তত দুই মাস ধরে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিরা তাঁকে অনুসরণ করেছে। তফসিল ঘোষণার পরদিন তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা ছিল অন্যতম লক্ষ্য।
আটক দুই ব্যক্তি সম্পর্কে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে লোক পারাপারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক দুই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, ফয়সলের পাসপোর্ট নম্বর পাওয়া গেছে। তাঁর সর্বশেষ ভ্রমণ তথ্য অনুযায়ী সম্ভবত গত জুলাই মাসে তিনি থাইল্যান্ড থেকে ফেরেন। এরপর ইমিগ্রেশন ডেটাবেজে আর তাঁর বহির্গমনের কোনো তথ্য নেই।
তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গতকাল বিকেলে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশ ইতিমধ্যে প্রধান সন্দেহভাজনের (ফয়সল) চলাচলের খতিয়ান বা ট্রাভেল হিস্ট্রি সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, আইটি ব্যবসায়ী পরিচয়ে তিনি কয়েক বছরে একাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সর্বশেষ গত ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর ভ্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে দুর্বৃত্তরা শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে। তিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
যে মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয়েছে, সেটার নম্বর শনাক্ত করে মালিককে গত শনিবার বিকেলে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাঁর নাম মো. আব্দুল হান্নান। মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় তাঁর বাসা।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ফয়সলের পুরো নাম ফয়সল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি দাউদ খান নামে নিজের পরিচয় দিতেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হান্নান জানিয়েছেন, এক বছর আগে তিনি মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে গতকাল তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ফয়সল ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে সাফি মুদ্দাসির খান ওরফে জ্যোতির ঘনিষ্ঠতা ছিল। জ্যোতির সঙ্গে ফয়সলের একাধিক ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে।
আদাবর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফয়সলের স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের একাধিক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের একান্ত সহকারী (এপিএস) মো. মাসুদুর রহমান (বিপ্লব) ও মোহাম্মদপুর এলাকার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ আহমেদের ভাতিজা ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আসিফ আহমেদের সঙ্গেও ফয়সলের ঘনিষ্ঠতা ছিল। আলমগীর শেখ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের রুবেল তাঁর অন্যতম সহযোগী ছিল।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ফয়সলের পুরো নাম ফয়সল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি দাউদ খান নামে নিজের পরিচয় দিতেন।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সল করিম। ওই মামলায় গত বছরের ৭ নভেম্বর আদাবর থেকে ফয়সল করিমকে দুটি বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন। যদিও ইতিমধ্যে অস্ত্র ও লুটের দুটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে।
টাকা লুটের মামলা ও অভিযোগপত্রে ফয়সলের বর্তমান ঠিকানা লেখা হয়েছে আদাবরের পিসি কালচারের ৯ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর বাড়ি। সে বাড়িতে গিয়ে গতকাল কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী জুয়েল রানার সঙ্গে। তাঁর দাবি, তিনি এক মাস আগে এই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগ দেন। তিনি ফয়সল করিমের বিষয়ে কিছু জানেন না। তিনি বলেন, দোতলায় বাড়ির মালিক থাকেন।
দোতলায় গিয়ে কথা হয় এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, এই বাড়ি তাঁদের। ফয়সল করিম বা তাঁর পরিবার কখনোই এই বাড়িতে ছিল না। ফয়সলের পরিবারের কাউকে তিনি চেনেন না। পুলিশ এই বাড়ির ঠিকানা কেন বলছে, সেটি তিনি বুঝতে পারছেন না।
আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ফয়সল করিম গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আদাবরের উল্লিখিত বাসার দোতলায় ভাড়া থাকতেন। ৫ আগস্টের পর তাঁরা ওই এলাকা ত্যাগ করেন।
দোতলায় গিয়ে কথা হয় এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, এই বাড়ি তাঁদের। ফয়সল করিম বা তাঁর পরিবার কখনোই এই বাড়িতে ছিল না। ফয়সলের পরিবারের কাউকে তিনি চেনেন না। পুলিশ এই বাড়ির ঠিকানা কেন বলছে, সেটি তিনি বুঝতে পারছেন না।
কিন্তু ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের আড়াই মাস পর মামলা ও ছয় মাস পর অভিযোগপত্রেও ফয়সল করিমের বর্তমান ঠিকানা হিসেবে পিসি কালচারের ৯ নম্বর সড়কের ওই বাড়িই উল্লেখ করা হয়। এর কারণ জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মনমথ হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ফয়সল করিমের স্থায়ী ঠিকানা নিশ্চিত হওয়ায় সেটিও উল্লেখ করা হয়। আর বর্তমান ঠিকানার ক্ষেত্রে এজাহারে বাদীর উল্লেখ করাটাই অভিযোগপত্রে দিয়েছেন।
অবশ্য এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পটুয়াখালীর বাউফলের গ্রামের বাড়িতে ফয়সলের যাতায়াত ছিল না। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ফয়সলের সহযোগী আলমগীর শেখ আদাবর থানা যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন না। গত মাসে তিনি উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। হাদির ওপর হামলার তিন দিন আগেও উত্তরার ওই বাসায় তাঁকে দেখা গেছে।
হাদিকে গুলি করার ঘটনার আগে ফয়সল করিমের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীর মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে তাঁদের সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
সর্বশেষ গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যার পর র্যাব নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফয়সল করিমের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীকে আটক করেছে। তাঁদের পল্টন থানায় সোপর্দ করা হয়।
হাদিকে গুলি করার ঘটনার আগে ফয়সল করিমের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীর মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে তাঁদের সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।