গোলাম কিবরিয়াকে এলোপাতাড়ি গুলি করে দুর্বৃত্তরা
গোলাম কিবরিয়াকে এলোপাতাড়ি গুলি করে দুর্বৃত্তরা

পুলিশের অনুসন্ধান

বিদেশে বসে যুবদল নেতা কিবরিয়াকে হত্যার নির্দেশ, খুন করে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা

ঢাকার মিরপুরের পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ওই এলাকার এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আসছে, যিনি কয়েক বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। মফিজুর রহমান ওরফে মামুন নামের পলাতক ওই আসামি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে কিবরিয়াকে হত্যা করিয়েছেন। ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

কিবরিয়া হত্যার ঘটনা তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। তা ছাড়া ওই এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এলাকায় মামুনের পক্ষে চাঁদাবাজির কথা জানা গেছে। আর স্থানীয় বিএনপির নেতারা বলেছেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে কিবরিয়াকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মামুন। কিবরিয়া তাতে রাজি নন মামুন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।

নিহত কিবরিয়া (৪৭) ছিলেন পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব। পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করতেন বলে পরিবার জানিয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে মুখোশধারী তিন সন্ত্রাসী মিরপুর ১২ নম্বরের বি ব্লকে ‘বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি’ নামের একটি দোকানে ঢুকে খুব কাছ থেকে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ওঠে এবং দ্রুত না চালানোয় চালক আরিফ হোসেনের (১৮) কোমরে গুলি করে তাঁকে আহত করে। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারা জনি ভূঁইয়া (২৫) নামের একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ বলেছে, কিবরিয়াকে হত্যা করতে জনি ভূঁইয়াসহ কয়েকজনকে ভাড়া করা হয়েছিল। হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া অপর দুজনকেও শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এ হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার ওরফে দীনা বাদী হয়ে আজ পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় আসামি হিসেবে জনিসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অপর আসামিরা হলেন সোহেল ওরফে পাতা সোহেল ওরফে মনির হোসেন (৩০), সোহাগ ওরফে কালু (২৭), মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম (২৮) ও রোকন (৩০)। এ ছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় আরও সাত-আটজন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে পল্লবী থানা–পুলিশ।

পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, আটক জনি ভূঁইয়া যুবদল নেতা কিবরিয়া হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, কিবরিয়াকে হত্যা করার জন্য তাঁকেসহ কয়েকজনকে ভাড়া করা হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।

মফিজুর রহমান ওরফে মামুনকে ২০২১ সালে পল্লবী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য

মাদক ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ

ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের একাধিক নেতা ও মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পল্লবী এলাকার শীর্ষসন্ত্রাসী মফিজুর রহমান ওরফে মামুন মালয়েশিয়ায় এবং তাঁর ভাই মশিউর ওরফে মশি ভারতে পালিয়ে আছেন। সম্প্রতি মামুন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ তাঁদের লোকদের পাইয়ে দিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু কিবরিয়া তাতে রাজি হননি। এ ছাড়া কিবরিয়ার কাছে মামুন টাকা পেতেন। সেই টাকা পরিশোধে কিবরিয়া টালবাহানা করছিলেন। এসব কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে মামুন লোক ভাড়া করে কিবরিয়াকে হত্যা করিয়েছেন বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন নেতা বলেন, একসময় কিবরিয়া মামুনের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। ২০-২৫ বছর আগে কিবরিয়া তাঁর সঙ্গ ছেড়ে দেন। মামুনের সঙ্গে যোগাযোগও করতেন না কিবরিয়া। এসব কারণে কিবরিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারেন মামুন।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, মামুন বিদেশে বসে ওই এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। কিছুদিন আগে কিবরিয়া সেখানে চাঁদা নিতে এলে মামুনের লোকজন বাধা দিয়েছিল। মামুন ফোন করে তাঁকে সেখানে যেতে নিষেধ করেছিল। এ ছাড়া মামুন পল্লবী থানা যুবদলের কমিটিতে তাঁর কিছু লোককে ঢুকাতে কিবরিয়াকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিবরিয়া তা শোনেননি। এসব কারণে মামুন তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন।

মামুনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ডাকাতির অভিযোগে পল্লবী থানায় ২৭টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ১৫টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও ২টি সাজা পরোয়ানার তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মামুনকে ২০২১ সালে পল্লবী থেকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতে বসে মিরপুরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিলেন মামুন। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে মামুন মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান বলে পুলিশ জানায়।

আজ পল্লবীর একাধিক স্থানে মফিজুর রহমান ওরফে মামুনের পোস্টার ঝুলতে দেখা যায়। পোস্টারে তাঁর পদ লেখা রয়েছে ৯১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। এ বিষয়ে বিএনপির এক নেতা বলেন, পল্লবী থেকে মামুনের পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নিরাপত্তাহীনতায় যুবদলের নেতারা

কিবরিয়া হত্যার পর যুবদলের নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজ আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকতাম, কোনো ঝুঁকি ছিল না। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হচ্ছে। এতে দলীয় লোকদের মধ্যে সন্ত্রাসী, বদমাশ ও সুবিধাবাদী লোক ঢুকে গেছে। এ অবস্থায় আমরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছি। সে কারণেই কিবরিয়ার মতো ত্যাগী নেতাকে হারিয়েছি।’

যুবদলের এই নেতা জানান, বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পল্লবী থানা এলাকায় বিএনপি ও ছাত্রদলের চারজন নেতা খুন হয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০০৫ সালে পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ ছাত্রদলের এক নেতা নিহত হন। এখন আবার যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঠিকমতো তৎপর থাকলে কিবরিয়া এভাবে খুন হতেন না বলে মনে করেন যুবদল নেতা সাজ্জাদুল।

কিবরিয়ার স্ত্রী–সন্তানদের কান্না

আজ দুপুরে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরের ফলপট্টি–সংলগ্ন কিবরিয়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, স্বামীকে হারিয়ে কেঁদে কেঁদে শয্যাশায়ী কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার। কাঁদছে তাঁদের দুই মেয়ে। স্বজনেরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সেখানে কিবরিয়ার ভাই গোলাম কবির উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের বাবা মোহাম্মদ আলী তালকুদার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ কারণে তাঁর বাবার নামে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ধ ব্লকে বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সেখানে কিবরিয়া সপরিবার থাকতেন। ২০১৪ সালে বাসার কাছে সন্ত্রাসীরা তাঁকে গুলি করে আহত করেছিল। কারা ও কেন হামলা করেছিল, সেই কারণ তাঁরা আজও জানতে পারেননি। এরপর কিবরিয়া সেখান থেকে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে বাসা ভাড়া নিয়ে সপরিবার ওঠেন। এখন কারা কেন তাঁর ভাইকে খুন করল, তা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না।

এর আগে আজ সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে লাশ নিতে যান কিবরিয়ার স্বজনেরা। সেখানে কিবরিয়ার শ্যালিকা সুফিয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভগ্নিপতি কিবরিয়ার সঙ্গে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারির মালিক মাসুদ রানার বন্ধুত্ব ছিল। সময় পেলেই প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁর ভগ্নিপতি ওই দোকানে বসে আড্ডা দিতেন। প্রতিদিনের মতো গতকাল সন্ধ্যায়ও সেখানে গিয়েছিলেন।

কিবরিয়ার বন্ধু শেখ সোহাগ বলেন, কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পেছনে একাধিক বিষয় সম্পৃক্ত বলে তাঁরা মনে করছেন। মাফিয়া-সন্ত্রাসী যারা ৫ আগস্টের পর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, তাদের যুক্ততা আছে। বিএনপির দলীয় পদ–পদবি পাওয়ার স্বার্থের বিষয়ও আছে।