মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা-বাগান। এই চা-বাগানেই আমি বড় হয়েছি। বাবা চা-শ্রমিক, রোজ ভোরে কাজে যেতেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করতেন। দিন শেষে মজুরি পেতেন মাত্র ১০২ টাকা। সেই টাকায় চলত পাঁচজনের সংসার। কিন্তু বাবা কখনো অভিযোগ করেননি। তিনি বলতেন, ‘জীবন যত কঠিনই হোক, মা, হাল ছেড়ো না।’ বাবার কথাটা আজও আমার ভেতরের শক্তি হয়ে আছে। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা পড়াশোনায় বাধা হয়েছিল। কিন্তু সেই বাধা অতিক্রম করেছি।
জীবন আমাদের প্রতিদিন কিছু না কিছু শেখায়। কেউ শেখে বইয়ের পাতায় চোখ রেখে, কেউ শেখে হেঁটে চলা জীবনের পথ থেকে। আমি বিশ্বাস করি, সত্যিকারের শিক্ষা আসে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। যখন আমরা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই, আবার উঠে দাঁড়াই, তখনই শেখা শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। তবু মনে প্রশ্ন জাগত, আমার স্বপ্ন কি সত্যিই একদিন পূরণ হবে?
স্বপ্নের পথে প্রথম বৈষম্য
চা-বাগানে মেয়েদের নিয়ে সবার একটা ধারণা থাকে, ওরা কতটুকুই–বা পড়াশোনা করবে! ছোটবেলা থেকেই এ ধরনের কথা শুনেছি। কষ্ট হতো, কিন্তু থামিনি। মনে মনে বলতাম, ‘আমি পারব।’
বাবার কষ্ট দেখেই নিজের মধ্যে শক্তি পেয়েছি। স্কুলের পর টিউশন পড়াতাম, যাতে নিজের পড়ার খরচ কিছুটা নিজেই জোগাতে পারি। কখনো কখনো এমন দিন গেছে, দুপুরে শুধু রুটি খেয়েছি। তবু মনে শান্তি ছিল। কারণ, জানতাম, আমি চেষ্টা করছি, সামনে এগোচ্ছি। সেসব দিন আমাকে শিখিয়েছে, সফলতা মানে শুধু বড় কিছু পাওয়া নয়, বরং ছোট ছোট অর্জনগুলোকে ভালোবাসা, কৃতজ্ঞ থাকা। স্কুল ও কলেজে ভালো ফলাফল করলেও আমার সবচেয়ে বড় লড়াইটা ছিল নিজের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা। পরিবার তখনো ভাবত, মেয়েদের জন্য পড়াশোনা এতটা দরকারি নয়।
কখনো মানুষ উপহাস করেছে, কখনো নিজের ক্ষমতার ওপরেই সন্দেহ জেগেছে। কিন্তু প্রতিবারই ভেতরের একটা মৃদু কণ্ঠ বলেছে, ‘এগিয়ে চলো, হাল ছেড়ো না।’
নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে
কলেজে ভর্তি হওয়ার পরপরই আত্মীয়রা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য মা–বাবাকে বোঝাতে থাকেন। মা–বাবাও ভাবছিলেন, মেয়ের এত পড়াশোনার কী দরকার? এর চেয়ে সংসার করা ভালো।
আমি ভয় পেয়ে যেতাম। মনে হতো, স্বপ্নটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে! রাতে ঘুমাতে পারতাম না, সংসারের ভেতর ঢুকে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু ভেতর থেকে একটা শক্তি বলেছিল, ‘না, আমি থামব না।’
একদিন ঠিক করি, নিজেকেই নিজের লড়াইটা লড়তে হবে। বিয়েতে ‘না’ বলি। আর এটা বলামাত্র আত্মীয়স্বজন আমাকে আর আমার পরিবারকে ভয় দেখাতে শুরু করে, অপমান করে। এমনকি বাড়ির চারপাশে পেট্রল ঢেলে আমাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়েছিল!
সেদিন খুব ভয় পেলেও আরও শক্ত হয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি পড়ব, যে করেই হোক। নিজের আর নিজের পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। তাই নীরবে শুরু করি নিজেকে রক্ষা করার সংগ্রাম। গোপনে আবেদন করতে থাকি। চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) চা-বাগান অঞ্চলের মেয়েদের বিশেষ বৃত্তি নিয়ে পড়ার আবেদন করি। পেয়েও যাই পূর্ণ বৃত্তি। খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, এত দিনের কষ্ট যেন একমুহূর্তে সার্থক হয়ে গেছে।
এ ছাড়া প্রথম আলো ট্রাস্ট ও আইডিএলসি আমাকে অদ্বিতীয়া বৃত্তির জন্য নির্বাচিত করে। এই সুযোগ আমাকে শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়নি, বরং আমাকে আত্মবিশ্বাসী হতে, পরিবারের পাশে দাঁড়াতে এবং জীবনের লক্ষ্যগুলো আরও সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
সাফল্যের সিঁড়ি
এইউডব্লিউ থেকে আমি জনস্বাস্থ্যে স্নাতক করেছি। ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিয়িংয়ে করেছি ইন্টার্নশিপ। পরিবারের খরচ চালাতে ব্রাদার্স ফার্নিচার লিমিটেডে কমিউনিটি সেলস অফিসার হিসেবে কাজ করছি।
চা-শ্রমিক মা–বাবার মেয়ে হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছি, গবেষণা করছি—এসব ভাবলে আজও অবাক হই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন ভর্তি নিশ্চিত হলো, সেদিন রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু কেঁদেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি পেরেছি; চা-বাগানের মেয়ে হয়েও আমি নিজের ভাগ্য বদলাতে পেরেছি। স্নাতক শেষ করার দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের দিনগুলোর একটি। মা চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, ‘তুই সত্যিই পারলি, মা!’
বাবার মুখে সেই গর্বের হাসি দেখে মনে হয়েছিল, এই পৃথিবীর সব ক্লান্তি মুছে গেছে। সেই দিনটি আমাকে নতুন করে শিখিয়েছিল, যত বড় বাধাই আসুক, বিশ্বাস আর পরিশ্রম থাকলে স্বপ্ন একদিন সত্যি হবেই।
বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে
চা-বাগানের মেয়ে হয়ে এই পথটা আমার জন্য সহজ ছিল না। এই পথে ছিল কাঁটা, ছিল চোখের জল, ছিল না–বলা কষ্ট। কখনো মানুষ উপহাস করেছে, কখনো নিজের ক্ষমতার ওপরেই সন্দেহ জেগেছে। কিন্তু প্রতিবারই ভেতরের একটা মৃদু কণ্ঠ বলেছে, ‘এগিয়ে চলো, হাল ছেড়ো না।’
আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই, দেখি, প্রতিটি কষ্টই ছিল প্রয়োজনীয়। কারণ, সেসব কষ্টই আমাকে আজকের আমিতে পরিণত করেছে।
যে স্বপ্ন দেখি
আমার গল্পটা শুধু আমার নয়; এটা হাজারো মেয়ের গল্প, যারা এখনো কোথাও না কোথাও নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে লড়ছে। আমি চাই তারা যেন জানে, চা-বাগান, পাহাড়, গ্রাম বা দারিদ্র্য—কোনো কিছুই তোমার স্বপ্ন থামাতে পারবে না। আমি পেরেছি, তোমরাও পারবে। কখনো নিজের স্বপ্ন নিয়ে লজ্জা পেয়ো না। মানুষ হাসবে, কথা বলবে, কিন্তু তোমাকে থামলে চলবে না। বিশ্বাস রেখো নিজের ওপর, সাহস নিয়ে এগিয়ে চলো। পড়াশোনা চালিয়ে যাও; কারণ, শিক্ষা তোমার মুক্তির চাবিকাঠি।
আমি চাই প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিটি মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। যেন তারা নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নিজের মতো করে জীবন গড়তে পারে। শিক্ষা শুধু জীবনে পরিবর্তন আনে না, নিজের প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন চা–বাগানের সব মেয়ে স্কুলে যাবে, বই হাতে নেবে, নতুন ভবিষ্যতের দিকে তাকাবে। তারা জানবে, তারা শুধু শ্রমিকের সন্তান নয়, তারা ভবিষ্যতের নেতা, শিক্ষক, চিকিৎসক, সমাজকর্মীও হতে পারে।
প্রিয়াংকা গোয়ালা
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন