অদম্য প্রচেষ্টায় নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন সেলিনা আক্তার
অদম্য প্রচেষ্টায় নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন সেলিনা আক্তার

কঠিন কিছুই না–১

অবহেলার জবাব, ভালোবাসায় দিতে চাই

দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব কক্সবাজারের রামু উপজেলার সেলিনা আক্তারের জীবন-গল্প।

আমি সেলিনা আক্তার, বেড়ে উঠেছি কক্সবাজারের রামুতে। জন্ম থেকেই দুটি সংকট মোকাবিলা করেছি—একটি হলো সংসারের অভাব, অন্যটি আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। জন্ম থেকেই পিঠ একটু বাঁকা ছিল, সাধারণ মানুষের মতো হাঁটাচলা করতে পারতাম না। পাড়া-প্রতিবেশীরা ‘কুঁজো’ বলে ডাকত। স্কুলে সহপাঠীরাও মিশতে চাইত না। আমার শৈশব মোটেও আনন্দদায়ক ছিল না। সবাই বলত, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আমি জীবনে কিছুই করতে পারব না।

তবে এসব কথায় আমি কখনো দমে যাইনি। মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম—শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজের চেষ্টাতেই কিছু করব। এমন কিছু করে দেখাব, মানুষ যেন চমকে যায়। শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।

যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে যান। ভাইয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলছিল আমাদের। অর্থের অভাবে পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায় আমার। সব আশা আর স্বপ্ন যেন দমে গেল। এভাবেই দিন পার করছিলাম। একদিন ব্র্যাকের জাহিদ ভাই আমার খোঁজ পেয়ে বাড়িতে আসেন। আমাকে বলেন, আপনি ব্র্যাক স্টার (STAR) প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে যোগ দিতে পারেন।

জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকেই সেলাই, মোবাইল সার্ভিসিং, কম্পিউটার ও মোটর সার্ভিসিংসহ নানা রকম কাজের প্রশিক্ষণের কথা জানলাম। আমার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মোবাইল সার্ভিসিং শিখতে রাজি হলাম। তবে আমার পরিবারের এতে সম্মতি ছিল না। তাদের মতে, মোবাইল সারানো ছেলেদের কাজ, আমি পারব না। তার চেয়ে আমি যেন সেলাইয়ের কাজ শিখি।

পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলতে শুরু করল, তুমি লেখাপড়া বেশি করোনি। এসব পারবা? সবার কথা শুনে আমিও একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, আমি কি আসলেই পারব! সেলাই তো সবাই জানে, আমি বরং নতুন কিছু শিখি।

চ্যালেঞ্জটা নিলাম। নিজেকেই নিজে বললাম—সেলিনা তুমি সাহস রাখো, সুযোগ কাজে লাগাও।

শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করে নিজের চেষ্টায় এমন কিছু করে দেখাতে চেয়েছেন সেলিনা, যা আশপাশের মানুষকে চমকে দেবে। সেলিনা তা পেরেছেন

অবশেষে শুরু হলো মোবাইল সার্ভিসিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ। শুরুর দিকে কিছুই বুঝতাম না। ধীরে ধীরে নানা বিষয় আয়ত্ত করতে থাকি। মোবাইলে কীভাবে আইসি লাগাতে হয়, ডিসপ্লে ঠিক করতে হয়, চার্জিং সমস্যার সমাধান এবং মোবাইল ওয়াশসহ নানা বিষয়ে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিলাম।

টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আরও এমন কিছু বিষয় শিখেছি, যা আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করেছে। যেমন গুছিয়ে কথা বলা। আগে তো প্রায় সারা দিন ঘরেই বসে থাকতাম। আশপাশের বাড়ির পরিচিত মানুষ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথাই বলা হতো না। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, শুধু দক্ষ হলেই হবে না, কথার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও বাড়াতে হবে। নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে।

এখানেও বাধার মুখোমুখি হলাম। অনেক মোবাইল সার্ভিসিং দোকানে যোগাযোগ করলাম, কিন্তু কেউ কাজের সুযোগ দিতে চায় না। অনেকেই বলল, তুমি তো মেয়েমানুষ। মোবাইল সার্ভিসিংয়ের মতো জটিল কাজ তুমি পারবে না, কাজেও নিয়মিত আসতে পারবে না, দোকানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে—ইত্যাদি নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্যে আমার মন ভারী হয়ে গেল।

তবে হতাশ হলাম না। অবশেষে একদিন ‘বিসমিল্লাহ টেলিকম’-এ চাকরি হলো আমার—শর্তসাপেক্ষে। তিন মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হলো। এই সময়ের মধ্যে আমার দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে, না হলে বিদায়।

আমিও কঠোর মনোযোগের সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। কোনো হাজিরা মিস করতাম না। কিন্তু দোকানের মালিক মজিদ ভাই আর সহকর্মীরা একটু সন্দেহের চোখে দেখত, আমি পারব কি না। ধীরে ধীরে সফলতার সঙ্গে বিভিন্ন কাস্টমারের মোবাইলের সার্ভিসিং করলাম। বিশেষ করে নারী কাস্টমাররা আমার সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। মোবাইলে কোনো সমস্যা হলে অনেকেই সরাসরি আমাকে ফোন দিতেন। তিন মাস নয়, দুই মাস পরই দোকান-মালিক আমার চাকরি কনফার্ম করলেন। ওটা ছিল আমার জীবনের বিশেষ একটি দিন।

আমি সব অবহেলা আর গঞ্জনার জবাব দিতে পেরেছি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে পেরেছি। আশপাশের দোকানের সহকর্মীরা আমাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করা শুরু করলেন। প্রতিবেশীরাও এখন আমার মা–বাবার কাছে আমার প্রশংসা করেন। তাঁদের ছেলেমেয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী কী প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তার জন্য পরামর্শ চান। কারও মোবাইলে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ফোন করেন বা বাসায় চলে আসেন। পথে দেখা হলে আগে মোবাইল দেখান। আমি যেন মোবাইলের ডাক্তার! আমি কখনো এসবে বিরক্ত হই না। আমার প্রতিজ্ঞা—একসময়ের সব অবহেলার জবাব আমি ভালোবাসায় দিতে চাই।

ধীরে ধীরে আমি সংসারের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করলাম। মা-বাবার ওষুধ খরচ নিজের উপার্জনের টাকায় কিনি। শুরুতে আমার বেতন ছিল ৪ হাজার টাকা, এখন সব মিলিয়ে মাসে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করি। অল্প অল্প করে কিছু সঞ্চয়ও করছি।

এখানেই থেমে থাকতে চাই না। টাকা জমিয়ে নিজেই একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান দিতে চাই। শুধু তা-ই নয়, আমার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যাদের আছে, বিশেষ করে নারীদের স্বাবলম্বী করতে চাই। প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মবিশ্বাসী করতে চাই। আমার দোকানে চাকরির সুযোগ করে দিতে চাই। সমাজকে বলতে চাই, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনোই কোনো বাধা নয়। স্বপ্ন দেখা থামানো যাবে না। নিজের পছন্দ এবং আগ্রহের বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বাধা আসবে, কিন্তু সাহস হারালে চলবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে দেরিতে হলেও সফলতা আসবেই।