শহরের একটি শান্ত সকাল। এমন সকালে প্রশস্ত, ছায়াঢাকা ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে দুই ভাইবোন। তারা হাঁটছে হাত–ধরাধরি করে। এমন একটা দৃশ্যের কথা ভাবুন তো। কী সুন্দর ছবি! প্রতিটি পরিবারে কিছু সুখের ছবি থাকে। ঠিক তেমনই এই ছবিও একটি নগরের সুখের ছবি।
শহরের এমন একটি ছবি তৈরি করতে অনেক নগরচিন্তক, নগরকারিগর ও প্রতিষ্ঠানকে চিন্তাশীল অবদান রাখতে হয়। শহরের দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনার চর্চা, সে অনুযায়ী অবকাঠামোর উন্নয়ন, নিরাপত্তা—সব মিলিয়ে এমন দৃশ্য তৈরি হয়। আর আমার কাছে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মানুষ এবং তার জন্য গণপরিসর সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করা।
গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো নগরে শিশু–কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। খেলার মাঠ, উদ্যান, জলাশয়, নদী, নির্মল বাতাস, সবুজ বনানী, নিরাপদ ফুটপাত—একটি নগরের গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অংশ। এসবই নগরের প্রাণ।
সফল শহরের সার্থকতা নির্ভর করে এর গণপরিসর কতটা উন্মুক্ত, কতটা সুন্দর করে ব্যবহার করা হয় এবং শহর কর্তৃপক্ষ কতটা সুন্দরভাবে তা গুছিয়ে রাখতে পারে, তার ওপর। নগরজীবনে গণপরিসরকে এমনভাবে বিন্যাস করা উচিত, যাতে মানুষে মানুষে অর্থপূর্ণভাবে দেখা করা, কথা বলা এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
আমাদের দেশের নগরগুলোয় সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন এবং সুশাসনের অভাবে শিশু–কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা যায়নি। দেশের গণপরিসর উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের ধরন খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে নগরের প্রায় সব পরিসরেই ক্ষমতাবান, সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তির অভিপ্রায় প্রাধান্য পেয়েছে।
নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের উপযোগী শহর এ দেশে তৈরি হয়নি। এখানে মালিকানাবিহীন যৌথ পরিসর ব্যবহারের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দর্শন সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে আমাদের শহরাঞ্চলে নগরজীবন কখনো আরামদায়ক হয়ে গড়ে ওঠেনি। নগরে বসবাসকারী মানুষের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল আচরণ না দেখালে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর কোনো দিন নিশ্চিত করা যাবে না।
নগর–পরিকল্পনার ভাষায় আমরা বলি, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ১৫ মিনিট হাঁটা দূরত্বে যেন একটি খেলার মাঠ অথবা পার্কের মতো একটি গণপরিসর পেয়ে যান।
স্বাস্থ্য অবকাঠামো
গণপরিসরের উপাদানগুলো সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই এই উপাদানকে আমরা স্বাস্থ্য অবকাঠামো বলি। এর মধ্যে উদ্যান বা পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ যেমন আছে, তেমনি আছে নদী, লেকসহ বিভিন্ন জলাশয়, সবুজ বনানী ও রাস্তাঘাট।
রাস্তা ও এর দুই পাশের ফুটপাত নগরজীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও গুরুত্বপূর্ণ গণপরিসর। এ ছাড়া স্টেডিয়াম, ব্যায়ামাগার, কমিউনিটি স্পেস, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, কমিউনিটি লাইব্রেরি, নদীর তীর, খোলা প্রান্তরকে গণপরিসরের অংশ হিসেবে ধরা হয়।
নিরাপদ ও প্রশস্ত খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান শিশু–কিশোরদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তেমনই নারী ও বয়স্ক মানুষসহ সবার জন্য পার্ক বা উদ্যান প্রয়োজন।
আমাদের ছোটবেলায় মাঠ ছাড়া একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কল্পনা করা যেত না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাড়া, মহল্লা বা ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ থাকা দরকার। নগরে খোলা আকাশের নিচে দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। খেলাধুলা, বিতর্ক, বিজ্ঞান মেলা, স্কাউটিং ইত্যাদি সহশিক্ষা কার্যক্রম স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
শহরে পর্যাপ্ত সবুজ পরিবেশ ও জলাশয়ের ব্যবস্থা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ ঘটায়। লাইব্রেরি, শিশু–কিশোর ক্লাব, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আর্ট ও ক্র্যাফট কর্মশালা, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শিশু–কিশোরদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
উন্মুক্ত স্থানের প্রয়োজনীয়তা
একটি মাঠ বা উন্মুক্ত স্থান শুধু খেলার জন্য নয়। এখানে বড়রা সকাল-বিকেল হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। কোথাও কোথাও তা ঈদগাহ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আধুনিক নগর–পরিকল্পনায় এসব জরুরি। কারণ, দুর্যোগে জরুরি প্রয়োজনেও কাজে আসে। জনস্বাস্থ্য, সামাজিকতা, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে গণপরিসর ও উন্মুক্ত স্থানের গুরুত্ব অনেক।
গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অভাব নগরের শিশু–কিশোরদের শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং তাদের ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ, সামাজিক কাঠামো এবং জাতীয় উন্নয়নকেও গভীরভাবে বিপন্ন করছে। এ সমস্যা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে একটি দুর্বল, মানসিকভাবে অসুস্থ ও অনিরাপদ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করা হবে।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভাব
নগরে গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ঘাটতি শিশু–কিশোরদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আচরণগত বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মাঠ বা পার্ক না থাকায় খেলাধুলা, দৌড়ানো, লাফানো ও শরীরচর্চার সুযোগ থাকে না। এতে শিশু–কিশোরদের মধ্যে শারীরিক ফিটনেসের অভাব, উদ্যমে ঘাটতি, পেশি দুর্বলতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মুঠোফোন ও অন্যান্য গ্যাজেটে আসক্তিসহ স্ক্রিনটাইম বেড়ে যাচ্ছে।
উন্মুক্ত স্থান ও সবুজ এলাকা না থাকলে বাতাস ভারী হয়। হাঁপানি, অ্যালার্জি বাড়ে ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে। উন্মুক্ত স্থান না থাকলে হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়ামের অভাবে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার ও মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। খোলা বাতাস ও সবুজের মধ্যে সময় কাটানোর সুযোগ না থাকলে শিশু–কিশোরদের মানসিক চাপ, হতাশা ও উদ্বেগ বেড়ে যায়। এতে অপরাধপ্রবণতাও বাড়ে। প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলি বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে।
খেলার মাঠ না থাকলে অন্য শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় না। দলগত খেলার সুযোগের অভাবে নেতৃত্ব, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদির মতো ইতিবাচক দিকগুলোর বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বাধাগ্রস্ত হয় এবং শিশু–কিশোরদের আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে।
নগর–পরিকল্পনার সূচকে গণপরিসর
নগর–পরিকল্পনার ভাষায় আমরা বলি, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ১৫ মিনিট হাঁটা দূরত্বে যেন একটি খেলার মাঠ অথবা পার্কের মতো একটি গণপরিসর পেয়ে যান। আবার পাড়া-মহল্লাগুলোয় এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন শিশু–কিশোরেরা ছয় থেকে সাত মিনিট হাঁটা দূরত্বে একটা খেলার জায়গা পেয়ে যায়। এতে অনেক বড় জায়গা প্রয়োজন হয় না। একে বলে ‘প্লেয়িং লট’।
কমিউনিটি স্পেস বা নেইবারহুড মাঠের জন্য একটু বড়, অর্থাৎ ৫ থেকে ১০ একর জায়গার দরকার হবে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্লেয়িং লট, মিনি পার্ক, নেইবারহুড পার্ক ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের গণপরিসর থাকা দরকার। মেট্রোপলিটন পর্যায়ে পার্ক তৈরিতে আরও অনেক বড় জায়গার দরকার হয়, যেমন আমাদের রমনা উদ্যান। আগের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য তিনটি খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রত্যেক মানুষের জন্য শহরে কমপক্ষে ৯ বর্গমিটার করে সবুজ খোলা পরিসর থাকা প্রয়োজন। আর আমরা হিসাব করে দেখেছি, ঢাকায় এই তুলনায় মাত্র ৯০ ভাগের এক ভাগ উন্মুক্ত পরিসর আছে।
ঢাকা শহরের উন্মুক্ত স্থান কখনো ক্লাব দখল করে রাখে, কখনো চলমান প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী রেখে বন্ধ করে ফেলা হয়। ঢাকার ফার্মগেটের আনোয়ারা উদ্যান, বাংলামোটরে পান্থকুঞ্জ উদ্যান গত কয়েক বছরে সরকারি প্রকল্পের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা উদ্যানের অবস্থাও করুণ।
উত্তরা, গুলশান ও বনানীর মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায়ও পার্কের জায়গা প্লটে রূপান্তর করা হয়েছে। কোনো কোনো খেলার মাঠ ও উদ্যান সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।
সংরক্ষণে উদ্যোগ
উন্নত বিশ্বের অনেক বড় শহরে ‘ওপেন স্পেস অথরিটি’ নামে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। আর আমাদের দেশে উদ্যান, খেলার মাঠ ইত্যাদি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। এসব স্থানের জমি হয় ব্যক্তিমালিকানায় আছে, নয়তো দখল করা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে উদ্যোগ না নিলে এ ধরনের গণপরিসর সৃষ্টি করা যাবে না। কারণ, নগরায়ণের তালে জমির দাম বেড়ে যায়। তখন এটা কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিলে এ অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর যদি তাঁর মেয়াদে ওয়ার্ডে একটা করে উদ্যান বা খেলার মাঠ তৈরি করেন, তাহলে ঢাকায় প্রতি পাঁচ বছরে নতুন করে ১২৯টি গণপরিসর তৈরি করা যেতে পারে।
নগর–পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন, দ্রুত এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। হাজার-কোটি টাকা খরচ করে অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা তৈরি করি, কিন্তু নতুন গণপরিসর তৈরি করতে কেন অর্থের সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকবে না?
সুস্থ প্রজন্ম, মানবিক নগর
শিশু–কিশোরদের সুস্থ শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করতে নগর–পরিকল্পনায় সমন্বিত সুবিধা থাকা জরুরি।
একটি নগর মানে তো শুধু সুউচ্চ দালান আর রাস্তা নয়। এটা শিশু–কিশোরদের জন্য খেলাধুলা, শিক্ষা, সৃজনশীলতাসহ সবার শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চা, বিনোদনের জায়গা, একটা মানবিক শহর। সুস্থ প্রজন্ম গঠনের জন্য এটি শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, টেকসই নগর উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। মানবিক শহর গড়ে তুলতে মানসম্পন্ন সুন্দর গণপরিসরের বিকল্প নেই।
নগর–পরিকল্পনায় শিশু–কিশোরদের জন্য গণপরিসর ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা
করতে হবে।
আকতার মাহমুদ, নগর–পরিকল্পনাবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়