ভূমি ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বেলবাড়িতে ঘর পেয়েছে ৬০ পরিবার।

কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।’ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর এবং ঘরে বসবাসকারীদের দেখে বন্দে আলী মিয়ার কবিতার চরণগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
দিনকতক আগেও আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীরা কেউ কাউকে চিনতেন না। কেউ বাস করতেন সুন্দরবন ইউনিয়নে, তো কেউ ছিলেন চেহেলগাজী কিংবা ফাজিলপুর ইউনিয়নে। পেশায় কেউ ছিলেন ভ্যানচালক, কেউ ছিলেন কৃষিশ্রমিক। ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চালান এমনও আছেন কেউ কেউ। পূর্বপরিচিতি না থাকা কিংবা ভিন্ন পেশা, কোনো কিছুই বাধা হয়নি বসবাসকারীদের। অল্প সময়ে আত্মীয়তার বন্ধনে বেঁধেছেন পরস্পরকে।
সম্প্রতি দিনাজপুর সদর উপজেলার বেলবাড়ি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, সবুজ রঙের টিনের চালার ওপর উঁকি দিচ্ছে লাউগাছের লকলকে ডগা। ফাঁকে ফাঁকে শুয়ে আছে লাউ। ঘরের পাশে দোল খাচ্ছে কলাপাতা। দিনকয়েক পরেই মোচা বের হবে। খুঁটিতে বাধা ছাগলগুলোকে সবুজ ঘাস এগিয়ে দিচ্ছেন গৃহিণী। ভ্যানের মধ্যে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন মাঝবয়সী একজন। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে সেলাই মেশিনের খটখট আওয়াজ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসবাসকারীরা শোনান তাঁদের ভালো থাকার গল্প।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ভূমি ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বেলবাড়িতে ঘর পেয়েছে ৬০ পরিবার। গত ৩০ মে পর্যন্ত ৪৮টি পরিবার বসবাস শুরু করেছে বেলবাড়িতে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে জেলার ১৩টি উপজেলায় ৪ হাজার ৭৬৪টি পরিবার, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩ হাজার ১২৫টি পরিবার এবং তৃতীয় পর্যায়ে ২ হাজার ৭২৯টি পরিবারের মধ্যে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আশ্রয়ণের প্রতিটি ঘরের সামনে টিন দিয়ে সীমানা দিয়েছেন বসবাসকারীরা। কেউ ব্যস্ত গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির খাবার দিতে, কেউ করছেন রান্না। বারান্দায় বসে শিশু-কিশোরেরা খেলছে। একটি ঘরের বারান্দায় বসে সেলাইয়ের কাজ করছেন হাবিবা আক্তার (৩৩)। জানালেন, আগে একই ইউনিয়নের রানীপুর এলাকায় অন্যের জমিতে বাসবাস করতেন। মাস ছয়েক হলো এখানে উঠেছেন। স্বামী রাশেদ আলী ভ্যানচালক। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ করে সামান্য আয় করেন হাবিবা। ঘরের বারান্দায় তিনটি ছাগল পালন করছেন। হাবিবা বলেন, ‘ভালো আছি, ছোট হলেও নিজের বাড়ি হয়েছে। মানুষের কথা শুনতে হয় না।’
একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন গমির উদ্দিন (৬০)। পেশায় দিনমজুর। কখনো ভ্যান চালান। অন্যের জায়গায় বসবাস করতেন। তিন মাস আগে স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছেন আশ্রয়ণের ঘরে। সকালে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় গাই–বাছুর বাঁধা। স্ত্রী গরুকে খাবার দিচ্ছেন। ঘরের পাশে লাগানো সজনে গাছের পরিচর্যা করছেন গমির উদ্দিন। বললেন, ‘শেষ বয়সে মাথা গোঁজার একটা ঠিকানা হইছে। মেয়ে জামাই একটা গরু কিনে দিয়েছে। সেটি লালন–পালন করছি। দিনে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলছি। ভালো আছি।’
বেলবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীর সংখ্যা দেড় শতাধিক। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক শিশু-কিশোর। বসবাসকারীদের প্রায় প্রত্যেকেই একটুখানি জায়গার মধ্যে বিভিন্ন ফলদ ও সবজিগাছ লাগিয়েছেন। হাঁস–মুরগি পালন করছেন। তাঁদেরই একজন শরীফ জামাল বললেন, ‘প্রত্যেকে কোনো না কোনো কাজ করে খাই। প্রকল্প এলাকার পাশেই একটি পরচুলার কারখানা আছে। সেখানেও কাজ করেন কেউ কেউ।’ বললেন, ‘ঘরের চালে যে লাউ ধরেছিল, নিজেরা খেয়েছি, বিক্রিও করেছি। কলার গাছ লাগিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যে কলারও ফলন আসবে।’
তবে ভালো থাকার মধ্যেও খানিকটা অপূর্ণতা রয়েছে বসবাসকারীদের। জানালেন, শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ নেই। এতগুলো মানুষের ব্যবহারের জন্য নলকূপ মাত্র পাঁচটি। নলকূপগুলো খোলা জায়গায় হওয়ায় নারীরা তা ব্যবহারে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। প্রকল্পের তিনদিকে অন্যের আবাদি জমি। একপাশে পাকা রাস্তা। ময়লা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে। এ অবস্থায় আশ্রয়ণবাসীর একমাত্র চাওয়া, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আরও কয়েকটি নলকূপ সরবরাহ করা।