৩০টি ওয়ার্ডের আহ্বায়ক কমিটি করার জন্য সাতটি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে এই বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

বরিশাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের মধ্যে এবার বিভেদ দেখা দিয়েছে। নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের আহ্বায়ক কমিটি করার জন্য সাতটি কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে এই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর আগে গত বছরের ৩ নভেম্বর নগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে ৪২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এ নিয়ে আগের কমিটির বাদ পড়া নেতারা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা সংগঠিত হয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। এর মধ্যেই আহ্বায়ক কমিটির মধ্যেও বিভেদ দেখা দিল।
সাতটি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আহ্বায়ক কমিটির সভায় কোনোরকম আলোচনা বা মতামত না নিয়ে আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব এককভাবে এই কমিটি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন কমিটির বিক্ষুব্ধ নেতারা। এমনকি ওই কমিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়কের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করে নগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আলী হায়দার বাবুল গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা ওই কমিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন বলেই স্বাক্ষর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।’
বরিশাল মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। কমিটিতে মনিরুজ্জামান খান ওরফে ফারুককে আহ্বায়ক, আলী হায়দার ওরফে বাবুলকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। এরপর গত ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কেউ স্থান পাননি।
পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির জন্য কেন্দ্রে নাম জমা দেওয়ার পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা নিয়ে আপত্তি তোলেন বিলুপ্ত কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তাঁরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাঁদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি।
এতে বঞ্চিত নেতারা দলীয় কর্মকাণ্ডে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তবে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার জন্য এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে মহানগর আহ্বায়ক কমিটির মাথাব্যথার কারণ হয়েছেন। এতে মহানগর বিএনপিতে বিভক্তি প্রকাশ্যে চলে আসে। বাদ পড়া এই নেতারা সাবেক সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মহানগর কমিটির সভাপতি পদে ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার। সংসদ সদস্য, হুইপ ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাঁর শক্ত প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব।
মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে চলা দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের মধ্যে গত ১১ মার্চ সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
দলীয় সূত্র জানায়, ৫ জুন বরিশাল মহানগর বিএনপির নেতাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে অনলাইনে মতবিনিময় করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে মহানগর নেতাদের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি করার জন্য তিনি পাঁচটি নির্দেশনা দেন। এতে তিন মাসের মধ্যে নগরের ৩০ ওয়ার্ডে আহ্বায়ক কমিটি করে ভোটের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এসব আহ্বায়ক কমিটি করার জন্য সাতটি সাংগঠনিক কমিটি করার নির্দেশ ছিল।
দলীয় সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্দেশনা দেওয়ার ২২ দিন পর গত রোববার সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে মহানগর বিএনপির সভা ডেকে ওই ৭টি কমিটি ঘোষণা দিয়ে সংশ্লিষ্ট চিঠি দেন আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব। তবে ওই কমিটি করার ব্যাপারে সভায় কোনো আলোচনা করা হয়নি বলে অভিযোগ তোলেন আহ্বায়ক কমিটির একাধিক সদস্য।
আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আফরোজা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত রোববারের সভায় আমাকে ডাকা হয়নি। আমি লোকমুখে শুনে সভায় হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু সভায় কোনোরকম আলাপ-আলোচনা না করেই ওয়ার্ড কমিটি করার জন্য সাতটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। নগর কমিটির সাতজন যুগ্ম আহ্বায়ককে প্রধান করে ছয় থেকে সাতজনকে সদস্য রাখা হয়েছে এসব কমিটিতে।’
আফরোজা খানমের অভিযোগ, ‘যাঁদের দিয়ে এই কমিটি করা হয়েছে, তাঁরা দলে ১০ বছরের বেশি সময় নিষ্ক্রিয়। আমাকে কোনো কমিটিতে রাখা হয়নি কেন সভায় এটা জানতে চাইলে বলা হয়েছে, আমি ৫ জুন তারেক রহমানের সঙ্গ মতবিনিময় সভায় আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, এ জন্য রাখা হয়নি।’
আফরোজা খানম বলেন, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির নেতারা সবকিছু নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করতে কমিটির অন্য সদস্যদের মতামত ছাড়াই একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আহ্বায়কের বাড়িতে বসে সভা করে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই দায়িত্ব দেওয়ার আগে মহানগরের ১০ জন সদস্যকে নিয়ে আমার বাড়িতে সভা ডেকেছিলাম। সেখানে আলী হায়দার বাবুল ও অপর একজন যুগ্ম আহ্বায়ক ছাড়া বাকি ৮ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতিতে ৭টি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এখন আলী হায়দার বাবুল অভিযোগ তুলছেন আমার বাড়িতে সভা করা অগঠনতান্ত্রিক। পদে পদে এ রকম ভুল ধরলে তো সাংগঠনিক কাজ করা দুষ্কর হয়ে যাবে।’ এটা খুবই ছোট এবং নিজেদের ভেতরকার সমস্যা, সেটা নিয়ে বাইরে ক্ষোভ প্রকাশ করা কতটা যুক্তিযুক্ত, এমন পাল্টা প্রশ্নও রাখেন তিনি।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক বলেন, ‘এটা এমন কোনো কমিটি নয় যে তাঁকে বাদ দিয়ে আমরা বড় কিছু করে ফেলেছি। এটা সদস্যসচিব এককভাবেও দিতে পারতেন। আগে তো এমনই হয়েছে, মহানগর সভাপতির বাড়িতে বসে প্রায়ই মিটিং করে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেটা তো অগঠনতান্ত্রিক বলে প্রশ্ন তোলা হয়নি। তাহলে এখন কেন তোলা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। দল করতে হলে দলের স্বার্থ সবার আগে দেখা উচিত, ব্যক্তির নয়।’