Thank you for trying Sticky AMP!!

কক্সবাজার উপকূল উত্তাল, ১০ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি

কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীতে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা মাছ ধরার ট্রলার

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূল উত্তাল আছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চতায় কয়েক ফুট বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। এতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ী, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইলসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উপকূলের অন্তত ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে জেলা প্রশাসন। এ জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৫৭৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ প্রায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বহুতল ভবন। জরুরি মুহূর্তে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে।

এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস কক্সবাজার উপকূল থেকে ৫৯০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানার কথা। তারপরও আমরা দুর্যোগ মোকাবিলার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খালি রাখার পাশাপাশি কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য শুকনো খাবার ও পানি মজুতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে কক্সবাজারের আকাশ কোথাও মেঘলা, কোথাও ঝকঝকে। কোনো কোনো এলাকায় দাবদাহ বইছে, আবার কোথাও কোথাও হালকা বাতাস। সাগর উত্তাল রয়েছে। সাগরে যেন কেউ নামতে না পারে, সে জন্য পাহারা বসিয়েছে পুলিশ।

১০ লাখ মানুষকে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা। দ্বীপের ১০ হাজার বাসিন্দার জন্য এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে মাত্র দুটি। গত সোমবার বিকেল থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে সেন্ট মার্টিনে। সাগরও উত্তাল রয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চতায় তিন থেকে চার ফুট বৃদ্ধি পেয়ে দ্বীপের উত্তর, পশ্চিম দিকের ঘরবাড়িতে প্লাবিত হচ্ছে। কয়েকটি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নারকেলগাছ উপড়ে পড়ছে জানিয়ে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্বীপের ছয় হাজার মানুষকে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি চলছে। দ্বীপে দুটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বহুতল ভবনের ২৩টি হোটেল খোলা রাখা হয়েছে। সাগর প্রচণ্ড রকম উত্তাল থাকায় দ্বীপের অন্তত ৩০০ মাছ ধরার ট্রলার ৩০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদীতে সরিয়ে রাখা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকেলে সেন্ট মার্টিন জেটিঘাটে ঢেউয়ের ধাক্কায় যাত্রীবাহী একটি ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে দ্বীপের মানুষ আতঙ্কে, কারণ বেশির ভাগ লোকজনের ঘরবাড়ির ছাউনি পলিথিন ও শণের। ঝোড়ো হাওয়ায় নড়বড়ে ঝুপড়ি ঘরগুলো উপড়ে পড়তে পারে।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, মহেশখালীপাড়া, বাহারছড়া এলাকার অন্তত লাখো মানুষ ঝুঁকিতে আছে। তাদের সরিয়ে আনার জন্য অন্তত ৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেক উপকূলের অন্তত ৭০ হাজার মানুষকে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। এ জন্য শহরের ২০ থেকে ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হোটেল খোলা রাখা হয়েছে। আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের খাবারের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হবে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ বলেন, জেলার আটটি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ৫৭৬টি। এসব কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ৬ লাখ ৫ হাজার ২৭৫ জন। উপকূলে ঝুঁকিতে থাকা আরও অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের জন্য পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বহুতল ভবন খোলা রাখা হবে। এ জন্য পুরো জেলায় ৬ হাজার ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কক্সবাজার ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক খুরশেদ আলম বলেন, এখন কক্সবাজার উপকূলে ২ নম্বর সতর্কসংকেত চলছে। ৪ নম্বর সংকেত পড়লে স্বেচ্ছাসেবীরা মাঠে নেমে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সচেতনমূলক প্রচারণা শুরু করবেন। ৬ নম্বর সংকেত পড়লে স্বেচ্ছাসেবীরা লোকজনকে ঘরবাড়ি থেকে লোকজনকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনার কাজ শুরু করবেন। এ ব্যাপারে সব স্বেচ্ছাসেবীকে গত সোমবার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নিরাপদ আশ্রয়ে মাছ ধরার ৬ হাজার ট্রলার

শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা ফিশারিঘাটে নোঙর করে আছে অন্তত দুই হাজার মাছ ধরার ট্রলার। প্রতিটি ট্রলার পাহারা দিচ্ছেন একজন, দুজন করে জেলে।

এফবি সাদিয়া ট্রলারের জেলে রমজান আলী (৪৫) বললেন, সাগরে এখন মাছ ধরার কোনো ট্রলার নেই। অধিকাংশ ট্রলার ২০ মের আগে গভীর সাগর থেকে ঘাটে ফিরে এসেছে। কারণ, ওই দিন থেকে সাগরের মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলছে।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, জেলায় ছোট–বড় প্রায় ছয় হাজার মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে। সব নৌযান শহরের বাঁকখালী নদীসহ টেকনাফ, মহেশখালী, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও চকরিয়ার বিভিন্ন ঘাটে অবস্থান করছে। সাগরে এখন কোনো নৌযান নেই।

ভাঙা বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্ক

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভাঙা বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ী, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ও উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের বাসিন্দারা। কক্সবাজার সদর, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার কয়েকটি অংশেও কয়েক কিলোমিটার বাঁধ ভাঙা পড়ে আছে।

ধলঘাটা ইউপির চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বলেন, তাঁর এই ইউনিয়নের সরাইতলী ও সাইটপাড়ায় সোয়া এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি প্লাবিত হচ্ছে।
কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নেও কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা পড়ে আছে। এসব ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের প্লাবন চলছে। জোয়ারের ধাক্কায় বিলীন হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা। জোয়ারের ধাক্কায় বিলীন হচ্ছে ঝাউগাছ। কক্সবাজার সদর উপজেলার ভারুয়াখালী ইউনিয়নেও প্রায় ৪০০ মিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে বলে জানা গেছে।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, জেলার আটটি উপজেলায় পাউবোর বেড়িবাঁধ আছে ৫৯৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত ৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে একেবারে ভাঙা (বিলীন) অবস্থায় পড়ে আছে অন্তত ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে ভাঙা বেড়িবাঁধে মাটির বস্তা (জিওটেক্স) ফেলে সংস্কারের কাজ চলছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর ভাঙা বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে দুই কিলোমিটারের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন’–এর সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কক্সবাজারে ক্ষয়ক্ষতির তেমন আশঙ্কা না থাকলেও উপকূলের ১৫ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে আছে। কারণ, ইতিমধ্যে চিংড়িঘের তৈরির জন্য উপকূলীয় প্যারাবন ধ্বংস করা হয়েছে। প্যারাবনের ভেতরে তৈরি বেড়িবাঁধগুলোও নড়বড়ে হয়ে গেছে। উপকূলের লোকজনের আশ্রয়ের জন্য ১৯৯১ সালে যেসব ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছিল, তার কিছু ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জেলার লোকসংখ্যা এখন ২৬ লাখের বেশি। সে তুলনায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র খুবই অপ্রতুল। জেলায় গবাদিপশু আছে এক কোটির বেশি। দুর্যোগকালে পশুগুলোর রক্ষার নিরাপদ আশ্রয়স্থল নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা কমিটির সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে শুধু কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও চকরিয়া উপজেলায় অন্তত ৮৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। নড়বড়ে বেড়িবাঁধ এবং উপকূলীয় প্যারাবন উজাড়ের কারণেই প্রাণহানির ঘটেছিল বেশি। উপকূলের অবস্থা এখনো আগের মতোই।