পাহাড় থাকলে পাহাড়ধস হবে, এটি ধ্রুব সত্য। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরাও ওই অঞ্চলে এবারের মতো পাহাড়ধস কখনো দেখেননি। কী কারণে এমন ধস হলো, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। যেসব পাহাড়ে মানুষের বসবাস ছিল না, তেমন পাহাড়েও ধস হয়েছে। এর কারণ কী, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞ থেকে একেবারে সাধারণ মানুষ—সবাই একটা কথা বলার চেষ্টা করেছেন, পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি স্থাপন এবং পাহাড়ের বন উজাড় ধসের অন্যতম প্রধান কারণ।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সপ্তাহ রাঙামাটি ঘুরে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনবসতিহীন যে পাহাড়গুলোতে ধস হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই ছিল সেগুনবাগান। আর কিছু ছিল আম-লিচু ও অন্যান্য ফলের বাগান। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে সেগুন বন করা হলেও এই গাছটি ওই অঞ্চলের নিজস্ব (ইনডিজিনাস) প্রজাতি নয়। যেসব পাহাড়ে সেগুনবাগান করা হয়, সেখানকার মাটিতে দূর্বাঘাসও জন্মায় না। আম-লিচুর বাগান করার জন্যও পাহাড় কাটা ও প্রাকৃতিক বন উজাড় করা হয়। ফলে অব্যাহতভাবে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় হতে থাকে এবং পাহাড়গুলো নাজুক হয়ে পড়ে।
পাহাড়ধসের অরেকটি কারণ বলা হচ্ছে জুম চাষ। কিন্তু রাঙামাটি সদর, বরকল, কাপ্তাই ও কাউখালী উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, যেসব পাহাড়ে ধস হয়েছে, তার মধ্যে জুম চাষের পাহাড়ের সংখ্যা কম। ধসের কারণ হিসেবে কাপ্তাই হ্রদকেও দায়ী করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, ৭২৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে কাপ্তাই হ্রদের বর্তমান যে বিস্তৃতি, তা প্রাকৃতিক নয়। প্রাকৃতিক হ্রদটি ছিল অনেক ছোট, পাহাড়ের উপত্যকায় প্রবাহিত। সেই হ্রদের দুই পারে ছিল রাঙামাটি শহরসহ জনবসতি ও চাষাবাদ। দুই পারের পাহাড়গুলো ছিল আরও দূরে।
কিন্তু পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রাকৃতিক হ্রদের দুই পাড় তলিয়ে পানি পৌঁছে যায় পাহাড়গুলোর পাদদেশ পর্যন্ত। বাধ্য হয়ে জনবসতি স্থানান্তরিত হয় পাহাড়ের ওপরে। তখন থেকে প্রায় ৫৭ বছর ধরে পাহাড়ের পাদদেশ হ্রদ্রের পানিতে নিমজ্জমান। ফলে পাহাড়ের মাটির প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। বালু ও মাটির এই পাহাড়গুলো অনেক নাজুক হয়ে পড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। গত এক দশকে এই অঞ্চল ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পন হয়েছে। এতে পাহাড়গুলোতে কোনো ফাটল সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। এ ছাড়া ১৩ জুন পাহাড়ধসের আগে, তিন-চার দিন ধরে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে (তিন দিনে প্রায় ৫৯০ মিলিমিটার)। সেই বৃষ্টিতে নাজুক পাহাড়গুলোর মাটি ধসে পড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে আদি বাসিন্দাদের অনেকে ১৩ জুনের পাহাড়ধসের তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে বজ্রপাতকেও দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির পাশাপাশি ওই সময় অস্বাভাবিক রকম বজ্রপাত হয়েছে। ১২ জুন দিবাগত রাতের শেষ প্রহরে প্রায় চার ঘণ্টা মুহুর্মুহু বজ্রপাত হয়েছে। বজ্রপাতে সৃষ্ট কম্পন পাহাড়ধসের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী বলে রাঙামাটির প্রবীণ বাসিন্দাদের কেউ কেউ মনে করেন।
পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে ওই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছাড়াই রাস্তাঘাট ও স্থাপনা নির্মাণেরও দায় থাকতে পারে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, পাহাড়ি অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য সমতলের চেয়ে আলাদা। কাজেই পাহাড়ি এলাকায় রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও ভবনাদি নির্মাণের আগে ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত অসংখ্য রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও ভবনাদি নির্মিাণ করা হলেও কোনো ক্ষেত্রেই ভূতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়নি। ফলে ভূতাত্ত্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় হয়তো অনেক রাস্তা, বাড়ি নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলো ধসের কবলে পড়েছে।
কোনো একটি কারণে এ রকম ভয়াবহ পাহাড়ধস হয়েছে বলে কেউই মনে করেন না। সবাই বিশ্বাস করেন, এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রাকৃতিক কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষের সৃষ্ট কারণও।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ, সম্পদ, সর্বোপরি প্রকৃতিকে সুরক্ষিত করার জন্য, ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ধসের কারণগুলো নির্ণয় করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। তবে সেখানে বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীদের চেয়ে আমলাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে কোনো অবকাঠামো তৈরি না করতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিলেও এখন পর্যন্ত সরকার সে রকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি।