
ঝালকাঠিতে সবজির ভালো উৎপাদন হয়—এমন ইউনিয়নের মধ্যে অন্যতম সদরের গাভারামচন্দ্রপুর। পদ্মা সেতু চালুর প্রভাব পড়েছে ইউনিয়নটির গাভা গ্রামের কৃষক জালাল হোসেনের মনেও। আগে তাঁর খেতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বরিশাল শহরের মোকামে বিক্রি করতে হতো। এখন তিনি সরাসরি ঢাকায় পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন।
শুধু কৃষক জালাল হোসেনই নন, ঝালকাঠি সদরের তেরআনা গ্রামের নূর আলম, হোসেনপুর এলাকার কৃষক সুজন হাওলাদারদের মনেও আনন্দ। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ায় উন্মুক্ত হবে ঝালকাঠির সঙ্গে সড়কপথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের সব কটি বাণিজ্যিক পথ। বিশেষ করে দক্ষিণের সবজির বড় মোকাম বলে খ্যাত এ জেলায় ঘটবে কৃষিবিপ্লব। এমনটাই আশা করছেন জেলার কৃষকেরা।
সদর উপজেলার বাউকাঠি গ্রামের কৃষক হরিপদ দাস বলেন, দ্রুত পচনশীল সবজি হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য জেলায় কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই জমি থেকে তুলে এনে স্বল্প মূল্যে এত দিন পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হতো। হরিপদ দাসের দাবি, এখন পদ্মা সেতুর কল্যাণে তিন ঘণ্টার মধ্যে পাইকারেরা সবজি নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারবেন। এর আগে ঢাকা যেতে ফেরিতেই সময় লাগত প্রায় তিন ঘণ্টা।
ঝালকাঠি সদরের গাভারামচন্দ্রপুর, নবগ্রাম, কীর্তিপাশা, বিনয়কাঠি এবং রাজাপুর সদর ইউনিয়নে জেলার সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদিত হয়। পাশাপাশি ধান আবাদও হয় প্রচুর। এসব সবজির মধ্যে লাউ, হরেক প্রকারের শাক, কাঁচকলা ও কাঁচা মরিচ উল্লেখযোগ্য। আবার দেশীয় ফলের মধ্যে আমড়া, পেয়ারা ও নারকেল উৎপাদনে এগিয়ে জেলাটি। ধান আবাদের চেয়ে সবজি আবাদে বেশি লাভ হওয়ায় অনেকেই এখন সবজি চাষে ঝুঁকছেন।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে বোরো ধানের উৎপাদন ৫১ হাজার ৮২৯ মেট্রিক টন। ৮ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়েছে। আবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের পরিসংখানে দেখা যায়, জেলার দক্ষিণাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য অর্থকরী ফল হিসেবে প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে ৯ হাজার মেট্রিক টন আমড়া উৎপাদিত হয়েছে। ৯০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন।
গত বৃহস্পতিবার সকালে সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের বাউকাঠি গ্রামের কৃষক হরিপদ দাস, সঞ্জীব হালদার, কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভিমরুলী গ্রামের পেয়ারাচাষি স্বপন দাস, শাহজাহান মোল্লা, সঞ্জয় চক্রবর্তী ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের কৃষক জামাল খলিফা ও শাহ আলম খলিফার সঙ্গে কথা হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের কৃষকদের জীবন-জীবিকায় কী ধরনের প্রভাব পড়বে, জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, পদ্মা পাড়ি দিয়ে তাজা সবজি ঢাকাসহ বড় শহরে পৌঁছে যাবে। এতে এ অঞ্চলের কৃষকেরা সবজিতে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছতার মুখ দেখবেন।
জগদীশপুর এলাকার সবজির পাইকার অমল হালদার বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কথা শুনেই তিনি ঢাকার কারওয়ান বাজার, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন আড়তে যোগাযোগ শুরু করেছেন। আড়তদারেরা জানিয়েছেন, ট্রাকে সবজি নিয়ে এলে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রির টাকা দেওয়া হবে। তবে ভোর পাঁচটার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে, যা এখন সম্ভব।
ভিমরুলী গ্রামের পেয়ারাচাষি সঞ্জয় চক্রবতী বলেন, এত দিন এ এলাকার বিখ্যাত আমড়া ও পেয়ারা এক দিন পর লঞ্চে ঢাকায় যেত। এখন পদ্মা সেতু পার হয়ে কয়েক ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া যাবে।
ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে দূরবর্তী উপজেলা কাঠালিয়ার পাটিখালঘাটা ইউনিয়নের কৃষক সুমাইয়া রুবি ও মাহাতাব উদ্দিন বলেন, আগে তাঁদের উপজেলা থেকে শুধু দূরবর্তী রুটের যাত্রীবাহী বাস চলাচল করত। এখন সরাসরি ঢাকা থেকে পাইকারেরা ট্রাক নিয়ে আমুয়া, বরগুনা ও কাঠালিয়ায় চলে আসতে পারবেন।
কাঠালিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. বশির বলেন, পদ্মা সেতুর চালু হওয়ায় ‘স্মল হোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্টের (এসএসিপি)’ মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকায় বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হবে। মাঠপর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে তাঁদের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে কৃষকদের সমিতির মাধ্যমে ঢাকায় বিক্রি করা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ফেরির অপেক্ষায় আর কৃষিপণ্য নষ্ট ও সময়ক্ষেপণ হবে না। কৃষকের নগদ ও ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। জেলা প্রশাসক জোহর আলী বলেন, ঝালকাঠির ব্র্যান্ড পণ্য শীতলপাটি, সবজি ও পেয়ারাচাষিদের এত দিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচিত হলো পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।