সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা সাঁওতালি। এই ভাষা সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ঠিক চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে সাঁওতালি ভাষাও রয়েছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম, এমনকি অনেক বয়স্ক মানুষও তাঁদের এ ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এমনকি তাঁরা এ ভাষায় লিখতেও পারেন না।
দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর এলাকায় এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ১৩০টি পরিবার বাস করে। এর মধ্যে মাথিয়াস টুডু (৫০) ও মারিয়া হেমব্রম (৪৪) দম্পতির দুই ছেলেমেয়ে। মাথিয়াস পেশায় কুলি আর মারিয়া বেসরকারি হাসপাতালের আয়া। এই দম্পতির বড় ছেলে দীপ্ত টুডু সুইহারী ক্যাথলিক মিশনের আবাসিকে থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। ওই দম্পতির মেয়ের বয়স আড়াই বছর। প্রায় সময় ছেলে বাড়িতে আসে। বাড়িতে মা-বাবা সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে। দীপ্ত টুডু শুনে, বোঝে; কিন্তু মায়ের ভাষায় উত্তর দিতে পারে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাথিয়াস টুডু জানান, তিনি সারা দিন বাইরে থাকেন। ছেলেকে তাই হোস্টেলে রেখে পড়াচ্ছেন। ছেলে নিজেদের ভাষার সবটুকু বুঝতে পারে, কিন্তু উত্তর দেয় বাংলায়।
মির্জাপুর এলাকার মাথিয়াস টুডুদের প্রতিবেশী শান্তি টুডু (৪৮) ২৭ বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের যুবক স্বপন রায়কে। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁদের সংসার। সাত বছর ধরে ছেলে প্রদীপ রায়কে হোস্টেলে রেখে পড়াচ্ছেন। ওই দম্পতির মেয়ে পূজা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সকালে মায়ের পাশেই বসেছিল পূজা। সাঁওতালি ভাষা বলতে পারে কি না, জানতে চাইলে পূজা জানায়, ‘মা যা কথা বলে, সব বুঝি। বলতে পারি না। বলব কার সঙ্গে, পাড়ায় কেউ সাঁওতালি ভাষা বলে না। স্কুলেও কারও সঙ্গে বলার সুযোগ নেই।’ ০
সাঁওতালদের পাড়ার শেষ মাথায় টংদোকান আছে বাবু টুডুর (৫২)। পেশায় একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে খানিকটা অবাক হয়ে যান এই প্রতিবেদক। সাঁওতাল হয়েও ৫৫ বছর বয়সেও সাঁওতালি ভাষা বলতে পারেন না বাবু টুডু।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশির দশকে দিনাজপুর শহরের কসবা এবং শিবরামপুর এলাকায় সাঁওতালি ভাষার বই প্রকাশের জন্য দুটি ছাপাখানা ছিল। এর মধ্যে শিবরামপুর এলাকায় সাঁওতাল এডুকেশন সেন্টারের একটি এবং অপরটি ছিল কসবা এলাকায় জ্ঞানসাধন কেন্দ্রে (বর্তমান সেন্ট ফিলিপস স্কুল)। তবে ছাপাখানা দুটির অনুমোদন না থাকায় ১৯৮৪ সালের দিকে তা বন্ধ হয়ে গেলে মুখ থুবড়ে পড়ে সাঁওতালি ভাষার চর্চা।
সাঁওতালদের নিয়ে লেখা কয়েকটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সান্তালী ছিল মৌখিক ভাষা। পরে ভারতীয় ভাষা চর্চায় ইউরোপীয়দের আগ্রহের কারণে সান্তালী ভাষা লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু হয়। ১৮৬০-এর দশকে ক্যাম্পবেল, স্ক্রেফসরুড এবং বোডিঙের মতো নৃতত্ত্ববিদেরা সান্তালী ভাষা লেখার জন্য বাংলা এবং লাতিন লিপি ব্যবহার করেন। তারই ধারাবাহিকতায় সান্তালী অলচিকি লিপিটি ভারতের ময়ূরভঞ্জ জেলার কবি রঘুনাথ মুর্মু ১৯২৫ সালে তৈরি করেন এবং সাঁওতাল সম্প্রদায় এই লিপি সর্বজনীনভাবে গ্রহণ করে।
সাঁওতালি ভাষায় ভারত ও বাংলাদেশে অনেক বই প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে হরিপ্রসাদ নাথের সহজ সাওতাঁলী ভাষা শিক্ষা (সংস্করণ-১), ক্ষুদিরাম দাসের সান্তালী বাংলা সম শব্দ অভিধান, পরিমল হেমব্রমের সাঁওতালি সাহিত্যের ইতিহাস, বংশীরাম মুরমুর সাঁওহেৎ চর্চা, সৌরভ সিকদার ও নাসিমা পলির বাংলাদেশের ভাষা ও লিপি, ল্যাঙ্গুয়েজ রিসোর্স হাব সম্পাদিত সাঁওতালি ব্যাকরণ উল্লেখযোগ্য।
সাঁওতালি ভাষার চর্চা কমে যাওয়ার বিষয়ে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সাঁওতালি ভাষা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁওতালি ভাষা চর্চার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে সাঁওতালরা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা করতে পারছেন না।’