মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আক্ষেপ করে মাজেদা বলেন, ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোটেই বাস্তবায়িত হয়নি।

মাতৃভাষা বাংলার প্রশ্নে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কয়েকজন শহীদ হওয়ার দুই দিন পর খুলনায় মিছিল বের করেছিলেন নারীরা। ওই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাজেদা আলী। মিছিল করার অপরাধে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে কয়েক দিন পালিয়েও থাকতে হয়েছিল তাঁকে। খুলনা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে মাজেদার সেই বীরত্বের কথা।
মাজেদার বর্তমান বয়স ৮৬। চোখে দেখতে পান না। তবে খুলনা নগরের সুন্দরবন আদর্শ কলেজের সাবেক ওই উপাধ্যক্ষের তখনকার স্মৃতি এখনো টনটনে। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে বাড়ির মধ্যে অনেকটা ঘরবন্দী হয়েই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। চার মেয়ে, নাতি–নাতনিদের নিয়েই সময় কাটে তাঁর। খুলনার ভাষাসৈনিকদের মধ্যে তিনিই কেবল বেঁচে আছেন। মাজেদা জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর স্ত্রী।
ভাষা আন্দোলনের সময়কার স্মৃতিচারণা করে মাজেদা বলেন, ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েটের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়তেন আর কে গার্লস কলেজে (বর্তমানে বয়রা মহিলা কলেজ)। ওই সময় তাঁদের ক্লাস হতো বর্তমান করোনেশন স্কুল ভবনে। থাকতেন ওই স্কুলেরই হোস্টেলে। ওই সময় রতন সেন, সচীন বসুসহ আরও কয়েকজন বামপন্থী রাজনীতিবিদের সংস্পর্শে গিয়ে বাম রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মাজেদা। ওই বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সানজীদা খাতুন একটি চিঠি পাঠিয়ে খুলনা স্কুল-কলেজে ছাত্রীদের নিয়ে ছাত্রী সংসদ গঠনের অনুরোধ করেন। সে অনুযায়ী তাঁদের কয়েকজন বান্ধবী ও হোস্টেলে থাকা করোনেশন স্কুলের অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রীদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করেন তাঁরা।
ওই দিনের মিছিলের কথাও উঠে আসে মাজেদার কথায়। তিনি বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে বাইরে গিয়েছিলাম। বিকেলের দিকে হোস্টেলে ঢোকার সময় দেখি গেটে বিএল কলেজের কয়েকজন ছাত্র দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এম নুরুল ইসলাম, মালিক আতাহারসহ আরও কয়েকজন। আমি তাঁদের আগে চিনতাম না। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকেই জানতে পারি, ঢাকায় বাংলা ভাষার দাবিতে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি করেছে। কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়েছেন। তাঁরা পরামর্শ দেন খুলনায় ছাত্রীদের নিয়ে একটি মিছিল করার। কিন্তু মিছিল করার মতো কোনো অভিজ্ঞতাই তখন ছিল না। তাঁরাই বুঝিয়ে দেন কী করতে হবে। সন্ধ্যার দিকে প্ল্যাকার্ড তৈরির জন্য কিছু বড় সাদা কাগজ, লেখার জন্য কালির দোয়াত ও আলতা, কিছু হোগলার চাটাই, কিছু গরান কাঠের লম্বা ডাল এবং কী লিখতে হবে, তা ছোট কাগজে লিখে দিয়ে যান তাঁরা।’
মাজেদা শিউলী ঝরা দিনগুলো শিরোনামে একটি আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন। সেই বইয়ে উল্লেখ রয়েছে ওই দিনের মিছিলের পটভূমি। এ ছাড়া কাজী মোতাহার রহমানের লেখা খুলনার গণমাধ্যম: ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ বইতেও ওই দিনের মাজেদার নেতৃত্বে ছাত্রী মিছিলের বর্ণনা আছে।
মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আক্ষেপ করে মাজেদা বলেন, ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোটেই বাস্তবায়িত হয়নি। দেশে বাংলা ভাষাচর্চা হচ্ছে না। বিশেষ করে রেডিও-টেলিভিশনে যেভাবে বাংলা ও ইংরেজির সংমিশ্রণে কথা বলা হয়, তাতে আরও বেশি অবাক হতে হয়।