সিডরের ১০ বছর

পুতুল রানীর জীবনযুদ্ধ

দোকানে কর্মরত পাথরঘাটার বকুলতলা গ্রামের পুতুল রানী। ছবিটি গত মঙ্গলবার বিকেলে তোলা l প্রথম আলো
দোকানে কর্মরত পাথরঘাটার বকুলতলা গ্রামের পুতুল রানী। ছবিটি গত মঙ্গলবার বিকেলে তোলা l প্রথম আলো

বকুলতলী। পাথরঘাটা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম। বকুলতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণ। পুতুল রানীর বাড়ি কোন দিকে জানতে চাইলে বললেন, ‌‘পুতুল দি? ওই তো দোকানে বসা।’

দোকান বলতে চার খুঁটির ওপরে টিনের একচালা ছোট্ট ঘর। চারপাশেও টিনের বেড়া। আছে চকলেট, কেক ও বাদামের মতো গুটি কয়েক পণ্য। বেচাকেনা কেমন হয়? পুতুল রানী বললেন, ‘দিনে ৩০০-৪০০ টাকা হয়; কিছু কমও হয়। এ দিয়েই সংসার খরচা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা। হাতে কাজ নেই তাই এসব নিয়ে বসেছি। কাজ পেলেই চলে যাব।’ কী কাজ করেন পুতুল রানী? যখন যে কাজ পান তা-ই। কিছুদিন আগে রাস্তায় মাটির কাজ করেছেন। তারপর চলে এল বর্ষা মৌসুম। ওই কাজ বন্ধ হয়ে গেলে ধানখেতে মাছ ধরেছেন। এভাবেই কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন।

জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী এই নারীর জীবনটা বরাবর এমন ছিল না। স্বামী উপজেলার চরলাঠিমারা গ্রামের নির্মল চন্দ্র মিস্ত্রি ছিলেন জেলে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে বেশ ভালোই চলছিল সংসার। ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে নিখোঁজ হন। নির্মল ফিরে আসবেন—এই অপেক্ষায় তাঁর স্ত্রী, দুই শিশুসন্তানের এই ১০ বছর কেটেছে। অপেক্ষা আর শেষ হয় না।

সিডরের তিন বছর পর বাবার বাড়ি বকুলতলীতে চলে আসেন পুতুল রানী। গেল ১০ বছরের জীবনসংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বারবার ঝাপসা হয়ে উঠছিল চোখ। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে উঠছিল কণ্ঠ। পুতুল রানী বললেন, বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। আবার ছেলে প্রসেনজিৎ মিস্ত্রি (১৫) ও মেয়ে পূর্ণিমা রানীর (১৩) ভবিষ্যৎ তাঁর হাতে। তাই ঘরে বসে থাকা আর সাজেনি। নামেন জীবনযুদ্ধে। সেই যুদ্ধে সড়কে মাটির কাজ, পুকুর খনন, পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, নদী-খালে মাছ ধরা, হাটে জিনিসপত্র বিক্রি করা, এনজিওর ডাকে পথনাটকে অভিনয় একেকটা অংশ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুতুল রানী বলেন, ‘বলতে গেলে আজ আমি একজন পুরুষের চেয়েও বেশি কাজ করছি। কিন্তু প্রথমে শ্বশুরবাড়ি থেকে যখন কাজে হাত দিই, তখন বেশ লজ্জা লাগত। তাই সিদ্ধান্ত নিই, বাঁচতে হলে বাবার বাড়ি গিয়ে পুরোদমে কাজে নামতে হবে। না হলে ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারব না। সেই মনোবল থেকেই কাজে নেমে পড়া।’

ছেলে প্রসেনজিৎ এবার নবম শ্রেণিতে এবং মেয়ে পূর্ণিমা জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। বাবার চেহারাটাও ভালোভাবে মনে পড়ে না প্রসেনজিতের। তবে বাবা না থাকার যন্ত্রণাটা নাড়া দেয় তাকে। নাড়া দেয় মায়ের দিনরাত পরিশ্রমের কষ্টটাও। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীরে শুকনো মুখ নিয়ে মাকে বাড়ি ফিরতে দেখে প্রসেনজিৎ। পড়াশোনা করে বড় হয়ে একদিন মায়ের এই কষ্ট ঘোচানোর পণ করে সে।

সিডরের রাতে নির্মলের সঙ্গে একই ট্রলারে ছিলেন চরলাঠিমারা গ্রামের আরও আটজন। তাঁরাও ফেরেননি। আর পুরো উপজেলা ধরলে না ফেরা জেলের সংখ্যা ৪৬। তাঁদের পরিবারগুলো একই দুর্দশা মোকাবিলা করে এই ১০ বছর ধরে টিকে আছে।