বড়লোক হয়ে বিদেশ থেকে ফিরতে চাওয়া জয়ের লাশ এল বাড়িতে

জয় তালুকদারের লাশ বাড়িতে আসার পর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। আজ রোববার সকালে মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

‘আমার বাজানে কইছিল বিদাশ গিয়া বড়লোক হইয়া দেশে ফিরব। কিন্তু আমার বাজানে ফিরল লাশ হইয়া। ক্যান আমাগো লগে এমন হইল। ভগবান তুমি আমার বাজানডারে ক্যান কাইরা নিলা।’

অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির যাওয়ার পথে ঠান্ডায় মারা যাওয়া জয় তালুকদারের (২২) লাশ দেশে আসার পর এইভাবেই আহাজারি করছেন তাঁর মা লক্ষ্মী তালুকদার। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি গ্রামে তাঁর লাশ এসে পৌঁছায়। রাতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

গত ২৫ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির ল্যাম্পেদুসা দ্বীপে যাওয়ার পথে অতিরিক্ত ঠান্ডায় সাত বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরে। এর মধ্যে ইমরান হোসেন ও জয় তালুকদারের লাশ দেশে এল। মাদারীপুরের মারা যাওয়া বাকি তিনজনের মধ্যে কামরুল হাসানের লাশ আগামীকাল সোমবার দেশে আসার কথা রয়েছে। এ ছাড়া জহিরুলের লাশ ২০ ফেব্রুয়ারি ও সাফায়েতের লাশ ২১ ফেব্রুয়ারি আসতে পারে।

জয় তালুকদার বড়াইলবাড়ি এলাকার কাঠমিস্ত্রি প্রেমানন্দ তালুকদার ওরফে পলাশের ছেলে। স্বজন ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড়াইলবাড়ি এলাকার সোনা মিয়া খানের ছেলে জামাল খানের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ নভেম্বর সাত লাখ টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন জয় তালুকদার। দালাল প্রথমে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি দুবাই নেন। দুবাইয়ের একটি হোটেলে কয়েক দিন থাকার পর সেখান থেকে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। পরে লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় প্রায় দেড় মাস কাটানোর পরে গত ২২ জানুয়ারি অবৈধভাবে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন জয়সহ ২৮৭ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী। যাত্রাপথে ভূমধ্যসাগরে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের কবলে পড়ে ঠান্ডায় মারা যান জয় তালুকদারসহ মাদারীপুরের পাঁচ তরুণ।

প্রেমানন্দ তালুকদারের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জয় মেজো। জয়ের এমন করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না তাঁর স্বজনেরা।

প্রেমানন্দ তালুকদার বলেন, ‘দালালে বলেছিল, কোনো ঝুঁকি নাই। তাই ছেলেডারে ইতালিতে পাঠাতে গিয়ে জমিজমা যা ছিল, সবই প্রায় বিক্রি করে দিছি। অনেক লোকের কাছ থেকে ধারদেনাও করেছি। এখন মামলা করতে ভয় পাই, টাকা ছাড়া তো মামলা আগাবে না। উল্টো দালালরা প্রভাবশালী, ওরা আমাগো যা আছে, তা-ও কেড়ে নিব।’

জয়ের কাকা গোবিন্দ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে প্রদীপ, ভাতিজা জয়সহ বাড়ির চার ছেলে এই পথে ইতালি যায়। ওরা তিনজন কোনোমতে ইতালিতে পৌঁছালেও, জয় পথেই মারা যায়। জয়ের এমন মৃত্যু আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না। যে দালাল জয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, আমরা তার বিচার চাই।’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিমন রায় প্রথম আলোকে বলেন, ইতালিতে যাওয়ার পথে নিহত প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে পুলিশ কথা বলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নিহতের স্বজনেরা অজানা কারণে মামলা করতে আগ্রহী নন। তাঁদের অনেকভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এরপরও দালালদের চিহ্নিত করতে কাজ চলছে। মানব পাচার চক্রের জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।