সুনামগঞ্জে বন্যা

মা-ছেলে গাছের ডাল ধরে একঘণ্টা পানিতে ভেসেছিলেন

ঘরের সামনে থাকা এই কাঁঠাল গাছের ডালে ধরেই বন্যার পানিতে একঘণ্টা ভেসেছিলেন এই মা ও ছেলে। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফুলভরি নয়াহাটি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

তখন রাত আনুমানিক চারটা! ঘরে বুকসমান পানি। ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত। প্রবল বেগে হাওরের ঢেউ আর স্রোত ঢুকছিল ঘরের ভেতর। মেঝেতে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। খাটের ওপর উঠে আল্লাহকে ডাকছেন মা আর ছেলে। ঘর দুলছে। এর মধ্যেই খাট দেবে যায় মাটিতে। তখনই তাঁরা দুজন ঢেউ, স্রোত ঠেলে কোনোরকমে ঘর থেকে বের হন। দুয়ারের সামনে থাকা ছোট্ট কাঁঠালগাছের ডাল ধরে দুজন জড়াজড়ি করে ছিলেন এক ঘণ্টা। কালেমা পড়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আস্তে আস্তে অন্ধকার কাটে, ঢেউ কিছুটা কমে আসে। এরপর তাঁরা সাঁতরে গিয়ে আশ্রয় নেন গ্রামের একটি ঘরে। টানা ১০ দিন ছিলেন স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে।

সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সবকিছু হারানো ফিরিজা বেগম (৬০) সে দিনের ভয়ঙ্কর রাতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আঁচলে চোখ মুছে মুছে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘আমি বাপরে কই, কলেমা পড় রে বাবা। আর বাঁচতাম না। দুয়ারের কাছে কাঁঠালগাছটা না থাকলে হাওরে ভাইসা যাইতাম। আল্লাহই বাঁচাইছইন। ফিরা জনম পাইছি।'

ফিরিজা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফুলভরি নয়াহাটি গ্রামে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে করচার হাওর পাড়ি দিয়ে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পানি নামায় অনেকে বাড়িঘরে ফিরেছেন। কারও কারও বসতঘর একেবারে বিধ্বস্ত। বেড়া নাই, দরজা নাই এমন ঘরে আছেন অনেকে। গ্রামে মাত্র ১৪টি ঘর। এর মধ্যে ১২টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঁচ থেকে সাত বছর হয় এখানে মানুষজন নতুন বসতি গড়েছেন। কৃষিকাজ আর হাওরে মাছ ধরেই জীবন চলে তাঁদের। গ্রামের চারদিকে হাওরের থই থই পানি। ঘর থেকে সামনে-পেছনে পা ফেললেই হাওর।

ফিরিজা বেগম যখন কথা বলছিলেন তখন পাশে থাকা ছেলে বিল্লাল মিয়া (২৭) যেন অন্য ঘোরের মধ্যে। জানালেন, তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ছেলের বয়স দুই, মেয়েটার আট মাস। তারা সেদিন বাড়িতে থাকলে কীভাবে তাদের রক্ষা করতেন এটি মনে হলে এখনো শরীর কাঁপে তাঁর। আলাপকালে তিনি আরও জানান, পানি বাড়তে থাকে ১৪ জুন থেকে। পরদিন বউ আর দুই বাচ্চাকে দিয়ে আসেন শ্বশুরবাড়ি। ১৬ জুন বিকেল থেকে শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। রাত নামার আগেই ঘরে পানি ঢুকে যায়। শেষ রাতে ঘর থেকে বের হতেই হাওরের ঢেউ আর স্রোতের তোড়ে ঘরটি ভেঙে পড়ে।

বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমি খালি ওইটাই চিন্তা করি, আমরা দুইটা বাইচ্চা (ছেলেমেয়ে) বাড়িত থাকলে কিলা রক্ষা করতাম। ভাবলে মাথা আউলাই যায়। আমি গরিব মানুষ। ঘর বানাইমু কিলা, খাইমু কিলা ওইটাই ভাবি।’

সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অসংখ্য বাড়িঘর, অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। সুনামগঞ্জ টানা চার দিন সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সময়কালে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ছিল বন্ধ। সুনামগঞ্জ পৌর শহরে চার থেকে সাতফুট পানি হয়। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নেন বিভিন্ন শিক্ষপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘরে। তবে এখনো জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন আছেন। পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরেছেন, আবার যাঁদের বাড়িঘর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তারা ফিরতে পারছেন না।