বন্যাকবলিত এলাকায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বানভাসি মানুষজন আছেন বেকায়দায়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

সিলেটে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও মানুষের সংকট কাটেনি। পানিতে প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া অনেকে পুনরায় ফিরলেও টাকার অভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘর সংস্কার করতে পারছেন না। ত্রাণের জন্যও হা-পিত্যেশ করছেন অনেকে। বন্যাকবলিত এলাকায় বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। সব মিলিয়ে মানুষজন আছেন বেকায়দায়।
সচেতন বাসিন্দারা মনে করেন, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত, কার্যকর ও সমন্বিত ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া। আবার যেসব বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন কিংবা ব্যক্তি সরাসরি ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রেও সমন্বয় প্রয়োজন। ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি পুনর্বাসনের বিষয়টিও সরকারকে ভাবতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
এদিকে সিলেটের সার্বিক ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি আছে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যেহেতু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আছে, তাই সে মন্ত্রণালয় থাকা মানেই হচ্ছে তাদের সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে হবে। হঠাৎ বন্যা এল, আর বলা হলো প্রশাসন প্রস্তুত নয়। এটা অন্যের ক্ষেত্রে মানা যায়, কিন্তু প্রশাসনের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই মানা যায় না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সার্বিক প্রস্তুতি থাকাটাই হচ্ছে তাদের কাজ।’
এমন পরিসংখ্যানের পর আর বলার অপেক্ষা রাখে না, সিলেটে ত্রাণ অপ্রতুল কি না। এটা রীতিমতো উপহাস।ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, সিলেটের সভাপতি
সিলেটে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সে সবই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা শতভাগ বিতরণ করতে পারেননি। ত্রাণ যেন দ্রুততার সঙ্গে মানুষের হাতে পৌঁছায়, সেটা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুনর্বাসনের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
২১ জুন দুপুরে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ত্রাণের আশায় কয়েক শ মানুষ কার্যালয়ের সামনের ফটকে ভিড় জমিয়েছেন। অনেকে ত্রাণ না পেয়ে ফিরে গেছেন। চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মনাফ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া ত্রাণের পরিমাণ খুবই কম। কাকে রেখে কাকে দেবেন সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি হিসাবে, সিলেট জেলায় বন্যায় ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮৫১টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫১ জন প্লাবিত হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১ হাজার ৪১২ মেট্রিক টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বানভাসিরা মাথাপিছু ৬৪৫ গ্রাম চাল বরাদ্দ পেয়েছে। অন্যদিকে একেকজন বানভাসির বিপরীতে প্রায় ১০ টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এমন পরিসংখ্যানের পর আর বলার অপেক্ষা রাখে না, সিলেটে ত্রাণ অপ্রতুল কি না। এটা রীতিমতো উপহাস।
বন্যার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন দাম বাড়াতে না পারেন, এটা নিশ্চিত করতে বাজার তদারকি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া গেলে অভিযান চালানো হয়।ইমরুল হাসান, সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
সরকারি হিসাবে, সিলেট জেলায় বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ হাজার ৯৫৪টি। গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত সিটি করপোরেশন ও জেলার ১৩টি উপজেলার ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪৯ হাজার ৭৭২ জন আশ্রিত মানুষ ছিলেন। আশ্রিত লোকদের অধিকাংশেরই বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার পশ্চিম দর্শা গ্রামের গৃহপরিচারিকা মায়ারুন বেগম (৪০) ও স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কর্মরত মান্নান আহমদের (২৯) দুটি ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। পানি নেমে গেলেও ঘরগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। এখন ঘর মেরামতের সামর্থ্যও তাঁদের নেই।
গতকাল দুপুরে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ও মাসুকগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যপণ্য ও সবজির দাম অনেকটাই বেড়েছে। একদিকে বন্যায় জীবনযাপনে বিপর্যয় নেমে এসেছে, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রতি কেজি সবজি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি কেজি মুড়ি বন্যার আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোমবাতি, চিড়া, গুড়সহ বিভিন্ন পণ্য ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো দাম হাঁকাচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা নেই।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন দাম বাড়াতে না পারেন, এটা নিশ্চিত করতে বাজার তদারকি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া গেলে অভিযান চালানো হয়।
সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বাড়িঘরে পানি থাকায় এখনো অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। পৌর শহরের মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে পারলেও গ্রামের অনেকেই পারছে না। এখনো জেলার জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় পানিবন্দী মানুষ আছে। এসব উপজেলার নিচু এলাকায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে আছে বন্যার পানি। জেলা-উপজেলার মূল সড়কগুলো থেকে পানি নামলেও ইউনিয়ন ও গ্রামীণ সড়ক এখনো পানিতে প্লাবিত। পানি নামার পর নানা রোগ দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে ডায়রিয়াসহ পেটের পীড়াই বেশি, সঙ্গে রয়েছে চর্মরোগ।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জেলার দু-তিনটি উপজেলায় এখনো পানি আছে। তবে সব জায়গার পরিস্থিতিই উন্নতির দিকে। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ]