বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস

সুন্দরবনে বেড়েছে হরিণ, শিকার থামছে না

সুন্দরবনে এখন হরহামেশাই হরিণ দেখতে পান পর্যটকেরা। সম্প্রতি সুন্দরবনের কটকা এলাকায়
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে এখন হরিণের দেখা মেলে। খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। কোনো কোনো বন বিভাগের কার্যালয়ে দিনরাত সব সময়ই বন্য হরিণের দলকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। গত কয়েক বছরে এমন পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বন বিভাগ, গবেষক, বনজীবী থেকে শুরু করে বনসংশ্লিষ্ট সবাই সুন্দরবনে সাম্প্রতিক সময়ে হরিণের সংখ্যা বাড়ার কথা জানিয়েছেন। তবে হরিণের সংখ্যা নির্ধারণে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা নেই। শুধু বাঘের সংখ্যা নির্ধারণে গবেষণা হয়েছে। যদিও গত বছরের নভেম্বর থেকে হরিণ ও শূকরের সংখ্যা নির্ধারণে গবেষণা শুরু হয়েছে। এ গবেষণার ফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।

তবে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও তা শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত এক বছরে সুন্দরবনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১০ হরিণশিকারিকে মাংসসহ আটক করা হয়েছে।

কয়েক বছর আগেও কালাবগী ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন হাডড্র খাল এলাকায় অল্প কিছু হরিণ দেখা যেত। প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা ওই খালের বিভিন্ন জায়গায় এখন বাচ্চাসহ হরিণের দল দেখা যায়। ওই স্টেশন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, আগে হাডড্র খালের মাত্র একটি স্থানে কয়েকটি হরিণ দেখা যেত। আগে যদি ১০০টি হরিণ থাকত, এখন সেখানে কমপক্ষে ২৫০ হরিণ আছে। দিনরাত যেকোনো সময়ই স্টেশনের কাছেও হরিণ চলে আসে।

তবে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও তা শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত এক বছরে সুন্দরবনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১০ হরিণশিকারিকে মাংসসহ আটক করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে আটক হরিণশিকারিদের তথ্য থেকে দেখা গেছে, বনের পাশে যাঁদের বাড়ি, তাঁরাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা এবং বাগেরহাটের মোংলা ও স্মরণখোলা উপজেলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করেন।

লাফিয়ে গাছের পাতা খাচ্ছে হরিণ

তবে বন কর্মকর্তাদের দাবি, হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। র‍্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে হরিণ শিকারের সুযোগ কম। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এখন মাংসসহ হরিণশিকারি বেশি ধরা পড়ছেন বলে জানান তাঁরা।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনকে নিরাপদ করতে ২০১২ সালে টাস্কফোর্স গঠনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল অনেক বেড়েছে। এতে বনে অপরাধ অনেক কমে এসেছে। হরিণ শিকারের অন্যতম উৎস ছিল জলদস্যুরা। মূলত তাঁরাই হরিণ শিকার করে খেতেন। কিন্তু সুন্দরবন এখন বনদস্যুমুক্ত হওয়ায় হরিণ শিকার অনেক কমে গেছে।

এখন সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। এটা সুন্দরবনের জন্য সুখবর। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন পর্যটকেরা।
মিহির কুমার দো, প্রধান বন সংরক্ষক, খুলনা

হরিণের সংখ্যা বাড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে আবু নাসের বলেন, সুন্দরবনে রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হরিণ শিকার কমেছে। বছরের শেষের দিকে সুন্দরবনের দুবলার চরে অনুষ্ঠিত রাসমেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ সেখানে আসতেন। অল্প লোকবল দিয়ে এত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হতো না। এ কারণে ওই সময় বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকার করা হতো। কিন্তু তিন বছর ধরে বন বিভাগ মেলার ব্যাপ্তি কমিয়েছে। এখন শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই রাসমেলায় যেতে পারেন। ফলে অল্প মানুষকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, এখন সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। এটা সুন্দরবনের জন্য সুখবর। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন পর্যটকেরা। সুন্দরবন আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছে, এটাই তার প্রমাণ।

সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা নির্ধারণে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা নেই

হরিণ-শূকরের সংখ্যা নির্ধারণে গবেষণা

সুন্দরবনে কী পরিমাণ হরিণ ও শূকর আছে, তা নির্ধারণে গবেষণা শুরু হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে জার্মানির কেএফডব্লিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এ গবেষণা শুরু হয়েছে। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)।

সুন্দরবনকে ৬৫টি প্লটে ভাগ করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা এখন প্লটের মধ্যে থাকা হরিণ ও শূকরের মল নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করছেন। বিভিন্ন সময় সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষার পর গবেষণার বিভিন্ন তত্ত্ব ব্যবহার করে হরিণ ও শূকরের সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে।

এ গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনে বাঘ নিয়ে হওয়া গবেষণায় দেখা গেছে, বাঘের সংখ্যা মোটামুটি ভালো। এর বিপরীতে বাঘের খাদ্য বা অন্যতম প্রাণী হরিণ ও শূকর নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত কোনো তথ্য নেই, কোনো ভিত্তিও নেই। সেই ভিত্তি তৈরি করার জন্য এ গবেষণা শুরু হয়েছে। এ গবেষণার মাধ্যমে সুন্দরবনে বাঘের খাদ্যের একটি ভিত্তি তৈরি হবে। এতে বাঘের ধারণক্ষমতা যাচাই করাও সম্ভব হবে।