
১৯৭১ সালের ২২ মে রণাঙ্গন থেকে বড় ভাই আজিজুল হকের কাছে লেখা এক চিঠিতে চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান শহীদ মেজর নাজমুল হক লিখেছিলেন, ‘প্রয়োজনে আমি আমাকে ত্যাগ করব বাংলাদেশের যুদ্ধের জন্য। এই যুদ্ধ হয়তো চলতে থাকবে বছরের পর বছর, তারপরও ছাড়ব না। আমরা সবকিছুই হারিয়েছি। আমরা এখন মরিয়া হয়ে গেছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের লক্ষ্য স্বাধীনতা এবং আমরা স্বাধীন হব একদিন।’ সাধারণ একটি চিঠি, কিন্তু এটিতেই ফুটে উঠেছে একটি জাতির অঙ্গীকার, কোটি মানুষের স্বপ্ন আর এক মহান বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মবিশ্বাস। সেই মুক্তিযোদ্ধা, যিনি যুদ্ধের সূচনালগ্নে নওগাঁকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। তিনিই ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর নাজমুল হক। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সভা করে ফেরার পথে এই সম্মুখ সমরের নায়ক সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন। একাত্তরের মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির অন্যতম এই নায়কের কর্ম ও জীবন বিস্মৃতই রয়ে গেল।
মেজর নাজমুল হকের দূরদর্শিতা, অসীম সাহস, সাংগঠনিক নৈপুণ্য এবং দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ, আদর্শবাদিতা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী ও অনুকরণীয়। মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ। একাত্তরে পরিবার-পরিজন, স্ত্রী, অবোধ সন্তানদের কথা না ভেবে তিনি সব ঝুঁকি মাথায় নিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে বিশাল রণাঙ্গন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ৭ নম্বর বিশালকায় সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্র, রসদ, কাপড়চোপড়, ওষুধ ইত্যাদি জোগাড় করার পাশাপাশি গেরিলাযুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটানো এবং দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে ভারতে পালিয়ে না গিয়ে অস্ত্র কাঁধে চাষ করে ফসল উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে পরামর্শ দিতেন আর স্বাধীনতাযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক জনগণকে সম্পৃক্ত করতেন তিনি। জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থন আর সহযোগিতায় স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তিনি দেশের অভ্যন্তরে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন এক বিশাল মুক্তাঞ্চল। সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হকের যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা, গেরিলাযুদ্ধের কৌশল, পিপলস মোটিভেশন, সাংগঠনিক নৈপুণ্য ও অদম্য সাহস আর মনোবল শুধু তাঁর সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, বরং ৭ নম্বর সেক্টরের প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক, প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমকেও আকৃষ্ট করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.) বলেছেন, মেজর নাজমুল প্রথমে এই প্লাটুনের গোলাবারুদ যেন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে না যায় তা নিশ্চিত করেন। যুদ্ধের সময় ২৮ মার্চের একটি অপারেশনের পর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। জনতার সহায়তায় ওই দিন ইপিআর বাহিনী নবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে যখন রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন নাটোর ও নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে দ্বিমুখী আক্রমণ করেন মেজর হক। এতে পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।
রাজশাহী জেলার রহনপুরেও হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিলেন তিনি, যা তখনকার এক ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে পাওয়া যায়, ‘এপ্রিলের মাঝামাঝি ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল নগণ্য। বিশেষ করে মর্টার পরিচালনার জন্য আমাদের শিবিরে মাত্র তিনজন ইপিআর সৈন্য ছিলেন। ২৪ জন মুক্তিসেনা নিয়ে পুনর্ভবা নদীর তীরে রহনপুরের শত্রুর ছাউনি থেকে মাত্র ২০০ গজের ভেতরে আমরা তাঁর নেতৃত্বে মর্টার আক্রমণ চালিয়েছিলাম। তখন দেখেছি তিনি লুঙ্গি পরে মাথায় গামছা বেঁধে তিন ইঞ্চি মর্টার নিজে বহন করে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল।
নাজমুল হকের একটি অপারেশনের বর্ণনা দিয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল এম কে বাশার—মেজর নাজমুলের অধীনে একটি পুল উড়িয়ে নদীর উত্তর পাড়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন।
নাজমুল হকের আরেকটি অপারেশন সম্পর্কে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বলেন, দিনাজপুরের ধনধনিয়াপাড়ায় একটি বড় রকমের যুদ্ধ হয় ১৮ জুন। নিজেই এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন মেজর নাজমুল হক। ধনধনিয়াপাড়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে এবং ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ৪ জুলাই মেজর নাজমুল হক কাঞ্চন সেতুর ওপরে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এর মধে৵ই বাংলাদেশ সরকার এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁকে রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার এবং জুলাইয়ে ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১০ মে নিউজ উইকের ১০ মে সংখ্যায় ‘হক’স রিভেলিয়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে রণাঙ্গন থেকে সংবাদদাতা মিলান জে কিউবিক বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ২ মাইল অভ্যন্তরে একজন কৃষকের খামারবাড়ির পেছনের আঙিনায় সাধারণ বাঙালি পোশাক লুঙ্গি–পাঞ্জাবি পরিহিত মেজর নাজমুল হকের সাক্ষাৎ পাই। বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী সেনানায়ককে মনে হয়েছে অনেক প্রত্যয়দীপ্ত। Boundless Confidence.’
নাজমুল কিউবিককে বলেন, ‘আপনি এখন থেকে চার মাস পর যখন এখানে আসবেন, তখন ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করবেন। আমরা আপনাকে তখন সফল যুদ্ধের চিত্র দেখাব।’
নাজমুলের স্ত্রী নাওসাবা মিলি এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, ২৭ সেপ্টেম্বর সুজির হালুয়া ও ছোট মাছ রান্না করে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। সুন্দর করে একটা চিঠি লিখলেন স্বামীর জন্য। তাঁর রান্না নাজমুল খাবেন এই খুশিতে ড্রেসিং গ্লাসের সামনে বসে সাজতে শুরু করলেন। প্রথমে কপালে লাল টিপটি পরার সময় হঠাৎ করে দেয়ালে টাঙানো নাজমুল-নাওসাবা যুগলের ছবিটা পড়ে গেল এবং আয়নায় ফাটল ধরল মাঝবরাবর। অজানা ভয়–আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তাঁর বুক।
২৮ সেপ্টেম্বর সকালে কর্নেল জামান, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর (বীরশ্রেষ্ঠ) এলেন। সামনের রুমে নাওশাবাকে ডেকে বললেন, ‘Bhabi Sorry to say, yeasterday Maj. Najmul Died on Road Accident.’ এটা শুনেই নাওসাবা হুঁশ হারালেন। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি ভাবলেন হয়তো আহত, এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন সব শেষ।
মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিটিং শেষ করে নাজমুল ফিরছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন ড্রাইভার। পথিমধ্যে নাজমুল ড্রাইভারকে বললেন, ‘তুমি বেশ টায়ার্ড। দাও, গাড়ি আমি চালাই।’ তিনিও বেশ ক্লান্ত ছিলেন, ঝিমুনি এসে গিয়েছিল, অমসৃণ রাস্তায় গাড়ি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তার বুক গিয়ে ধাক্কা খায় স্টিয়ারিংয়ে। তাঁর পাশে বসা ছিলেন ইন্ডিয়ান লেফটেন্যান্ট। তাঁদের গাড়ির পেছনে ছিল ইন্ডিয়ান আর্মির হাই অফিশিয়ালদের একটি গাড়ি। এসে দেখেন মেজর নাজমুল ও ইন্ডিয়ান লেফটেন্যান্ট ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। ড্রাইভার পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। এই ড্রাইভারই পরে এসব নাওসাবাকে বলেছিলেন। কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান (অব.) বলেন, ‘সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় সোনামসজিদের পাশে তাঁর লাশ দাফনের ব্যবস্থা হলো।’
১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আজিজুল হক সাহেব চট্টগ্রাম থেকে একটি এপিটাফ তৈরি করে শহীদ নাজমুল ও বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কবরে স্থাপন করেছিলেন। আজিজ সাহেবই নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা দিয়ে নির্মাণ করেন এপিটাফটি।
‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত / আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না—’
নাজমুল রণাঙ্গন থেকে চিঠি লিখতেন ইংরেজিতে। ক্যালিগ্রাফির মতো অসাধারণ সেই হস্তাক্ষর। রণাঙ্গণ থেকে ১২ জুন এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘কয়েক মাসের মধ্যেই ভীরু ইয়াহিয়া বশ্যতা স্বীকার করবে। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে আমরা আমাদের মধুর মাটিতে ফিরে যেতে পারব স্বাধীন নাগরিক হিসেবে।’ সেই মধুর মাটিতে ফিরতে পারেননি নাজমুল। কিন্তু সেই মাটিতে তাঁর হৃৎস্পন্দন যেন আজও শোনা যায়।
●অভীক ওসমান: নাট্যকার, অর্থনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।