‘এত এত পুরস্কার পাইলু রে বাপ। কাইলকায় (গতকাল) মোর সাথোত কথা কহিলু রে। বাড়ি আসির চাইলু। আইজকা বাড়ি আসিলু রে বাপ, মোর বাপ আইজকা কথা কহচে নাই রে। তোর আসির কথা শুনিয়া পায়েস রান্না করিনুরে। মোর ছাওয়া কথা কহচে নাই।’
শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমসে পদকজয়ী মারুফ হাসনাতের অকালমৃত্যুতে বাড়ির আঙিনায় বসে এমন আহাজারি করছিলেন মা মিনু বেগম। ছেলেকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বেদনায় নির্বাক তাকিয়ে আছেন মারুফের বাবা আনিছুর রহমান।
মারুফ হাসনাতের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বড় বাউল গ্রামে। আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে চিরিরবন্দর রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে পড়ে মৃত্যু হয় মারুফের। তিনি দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। শেখ কামাল দ্বিতীয় যুব গেমসে অংশগ্রহণ শেষে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। এই প্রতিযোগিতায় সাইক্লিংয়ে তিনটি পদক লাভ করেন মারুফ। বিকেল সাড়ে চারটায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর এমন মৃত্যুতে পরিবার ও ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় শেখ কামাল দ্বিতীয় যুব গেমসে সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো অংশ নিতে যান মারুফ। চূড়ান্ত পর্বের খেলায় জিতেছিলেন তিনটি পদক। মারুফের বন্ধু জাকির হোসেন জানান, ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন বলে সেমিস্টারে ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই ঢাকায় চলে যান মারুফ।
দিনাজপুর স্টেডিয়ামে নিয়মিত সাইক্লিং অনুশীলন করতেন মারুফ। কলেজের পাঠগ্রহণ শেষে তাঁর ঠিকানা ছিল এই স্টেডিয়াম। ঘটনার সময় মারুফের সঙ্গে ছিলেন কোচ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, রংপুর বিভাগ থেকে মোট ১৬ জন এবার শেখ কামাল যুব গেমসে অংশ নেন। প্রথমবার অংশ নিয়েই মারুফ তিনটি পদক জিতেছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই তাঁর মধ্যে অনেক আনন্দ ছিল।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সোমবার রাত ১২টায় ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন তাঁরা। দিনাজপুরের আগের স্টেশন হচ্ছে চিরিরবন্দর। পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটির এখানে স্টপেজ নেই। এদিকে দিনাজপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া কাঞ্চন এক্সপ্রেস ট্রেনটির সঙ্গে ক্রসিং থাকায় পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটি গতি কমিয়েছিল। খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের সঙ্গে সাইকেল ও লাগেজ ছিল। এ জন্য তাঁদের কাছে নির্দেশনা ছিল, ট্রেন চিরিরবন্দর আসামাত্রই গন্তব্যে নামার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
চিরিরবন্দর স্টেশনের পাশেই সরকারি পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়। মারুফ এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্টেশনের কাছাকাছি এসে ট্রেনের গতি কমলে মারুফ দরজার কাছে গিয়ে হাতল ধরে অন্যদের তাঁর শৈশবের স্কুল দেখাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর হাত ফসকে যায় এবং সিগন্যাল বারের সঙ্গে মাথায় ধাক্কা লাগে। মুহূর্তে ট্রেন থেকে পড়ে যান। চলন্ত ট্রেন থেকে আর কেউ নামার সুযোগ পাননি। শুধু চোখের সামনে এক অসীম সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখতে হয়েছে।
চিরিরবন্দর উপজেলার বড় বাউল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মারুফদের চার কক্ষবিশিষ্ট জরাজীর্ণ মাটির বাড়ি। এক পাশে টিনের বেড়া, টিনের ছাউনি। এই বাড়ির একটি কক্ষে মারুফের পড়ার ঘর। ঘরের মধ্যে মাটির দেয়ালজুড়ে পদক, মেডেলসহ নানা পুরস্কার। স্কুলজীবন থেকেই খেলাধুলায় বেশ পারদর্শী ছিলেন বলে জানালেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা। দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্পসহ প্রায় সব খেলায় তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। জেলা পর্যায়েও কয়েকটি ক্যাটাগরিতে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
তিন ভাইয়ের মধ্যে মারুফ দ্বিতীয়। বাবা আনিছুর রহমান কৃষক। বড় ভাই একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আর ছোট ভাই স্থানীয় একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে। মারুফ সপ্তাহের পাঁচ দিনই চিরিরবন্দর থেকে ১৮ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেলের প্যাডেল মাড়িয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে যাতায়াত করতেন।
মারুফের সঙ্গে থাকা অ্যাথলেটরা জানান, যুব গেমসে পদক জয়ের পর থেকেই উচ্ছ্বসিত ছিলেন মারুফ। সোমবার তিনি তাঁর মাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘মা, আমি তিনটা পুরস্কার পাইছি। মেডেল পাইছি। রাতে ট্রেনে উঠব। সকালে দিনাজপুরে নামব। কলেজের কাজ সেরে বাড়িতে আসব।’ কিন্তু আজ বাড়িতে পৌঁছেছে মারুফের লাশ।
মারুফের অকালমৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা। সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সুব্রত মজুমদার বলেন, এবার রংপুর বিভাগের দুই জেলা (পঞ্চগড় ও দিনাজপুর) থেকে ১৬ জন প্রতিযোগী শেখ কামাল যুব গেমসে অংশ নিতে যান। সাইক্লিংয়ে দিনাজপুরের সবচেয়ে মনোযোগী প্রতিযোগী ছিলেন মারুফ। তাঁর অকালমৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কথাও জানান তিনি।