সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একাধিক সদস্যকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাহার উদ্দিন। গতকাল সকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামে
সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একাধিক সদস্যকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাহার উদ্দিন। গতকাল সকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামে

লক্ষ্মীপুরে ৭ জন নিহত

যাঁদের টানে দেশে ফিরলেন, তাঁদেরই কবরে শোয়ালেন বাহার

লক্ষ্মীপুরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের সাতজন নারী ও শিশু নিহত হয়েছেন। ওমানফেরত ছেলেকে আনতে গিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে মাইক্রোবাস খালে পড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্তব্ধ পুরো গ্রাম।

ওমানপ্রবাসী বাহার উদ্দিন স্বজনদের সঙ্গে ফিরছিলেন বাড়িতে। মা, স্ত্রী, মেয়ে, নানি, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইয়ের মেয়ে সবাই ছিলেন সঙ্গে। বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে অনেক হাসিঠাট্টা, খুনসুটি চলছিল। কিন্তু কে জানত মুহূর্তেই এই আনন্দের পরিবেশ পরিণত হবে বিষাদে।

গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামে এসে পৌঁছায় বাহারের নানি ফয়জুন নেসা (৮০), মা খুরশিদা বেগম (৫৫), স্ত্রী কবিতা বেগম (৩০), মেয়ে মীম আক্তার (২), ভাতিজি রেশমি আক্তার (১০), ভাবি লাবনী বেগম (৩০) এবং লাবনীর মেয়ে লামিয়া আক্তারের (৯) মরদেহ।

ওমান থেকে দেশে ফেরা বাহারকে আনতে ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু দেশে ফেরা আনন্দে শেষতক নেমে এল মৃত্যুর ছায়া। গতকাল ভোর পাঁচটার দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আলাইয়াপুর এলাকায় বাড়ি থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাসটি একটি খালে পড়ে। বাহার ছাড়া পরিবারের কেউই ফিরে আসেননি।

গতকাল সকালে বাহারদের বাড়ির ছোট উঠানজুড়ে সারি সারি সাতটি লাশ এনে রাখা হয়। খবর পেয়ে সকালেই লোকজন জড়ো হয়েছেন। শেষযাত্রার কিছু আয়োজনও সম্পন্ন হয়েছে। এক পাশে গোসলের জন্য টানানো হয়েছে শামিয়ানা। উঠানে পাতা হয়েছে চেয়ার। সবকিছুর মধ্যে নিদারুণ এক শোকের বার্তা।

যাঁদের জন্য প্রবাস থেকে ফেরা, তাঁদেরই কবরে শোয়ালেন বাহার। দুই বছরের মেয়ে মীমকে ভালো করে একটু বুকে জড়িয়ে আদরও করা হলো না। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় একসঙ্গে জানাজা হয় ছয়জনের। বাহারের নানি ফয়জুন নেসার লাশ নেওয়া হয় পাশের ইউনিয়ন হাজির পাড়ায়। বাকিদের দাফন হয় জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী গ্রামে।

পারিবারিক কবরস্থানে এক সারিতে দুটো কবর, সামান্য দূরেই চারটি। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সেখানেই একে একে মা খুরশিদা বেগম, স্ত্রী কবিতা, মেয়ে মীমসহ নিহত স্বজনদের শুয়ে দেন বাহার।

চৌপল্লী গ্রামে মানুষের ভিড়। এত মৃত্যু একসঙ্গে আর দেখেনি কেউ। শোকে স্তব্ধ গ্রামের বাসিন্দারা। গতকাল বিকেলে

চৌপল্লীর কাছারি বাড়িতে পাশাপাশি সাতটি ঘর। একটিতে থাকেন বৃদ্ধ আবদুর রহিম। বাহারের বাবা। ছেলে আসবে বলে গত কদিন ধরে কত প্রস্তুতি। এক মুহূর্তেই সব শেষ। ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ানোর শক্তিও তাঁর নেই। বিছানায় শুয়ে কাঁদছিলেন নিঃশব্দে। স্ত্রী, শাশুড়ি, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনিকে একসঙ্গে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ তিনি।

উঠানে দাঁড়িয়ে এক স্বজনকে বলছিলেন বাহার, ‘আমি ফিরছিলাম সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। অথচ ফিরে পেয়েছি সাতটা লাশ। আমি কারে নিয়ে বাঁচব এখন?’

একটু চুপ থেকে আবার বলা শুরু করেন বাহার, ‘গাড়িতে বসে আমরা কত হাসিঠাট্টা করতেছিলাম। আম্মা বলতেছিল, তোর জন্য কত অপেক্ষা করছি, বাপ। কথাটা শেষ হইতে পারে নাই। বিকট শব্দে ধাক্কা লাগে একটা। তারপর আর কিছু মনে নাই। খালের পানিতে ভাসতেছিল গাড়ি।’

দুর্ঘটনার জন্য চালকের ঘুমকেই দায়ী করছেন বাহার। তিনি বলেন, ‘কুমিল্লায়ও একবার গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছিল। বলেছিলাম, দরকার হলে ঘুমিয়ে নিন। কিন্তু তিনি ঘুম নিয়েই গাড়ি চালাতে গিয়েছেন। খালে পড়ে গেলে আমরা দরজা খুলতে বলি। কিন্তু তিনি নিজে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যান, আমাদের আটকে রেখে।’

এমন ঘটনায় শোকে আচ্ছন্ন পুরো চৌপল্লী গ্রাম। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল। আমাদের সবার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এ রকম দৃশ্য জীবনে দেখিনি। পুরো গ্রাম আজ শোকস্তব্ধ।’