
ঝিরি-ঝরনার পাথর ও জীবন্ত ব্যাঙ দাঁড়িপাল্লায় ঝুলছে। বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে। প্রাণ-প্রকৃতি যেন পণ্যে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ের নিসর্গ ও পাহাড়ি মানুষের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আঁকা এই ছবির সামনে দর্শকেরা মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান। শিল্পী খিং সাই মং মারমার আঁকা ছবিটি যেন পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতির দীর্ঘশ্বাস।
বান্দরবান জেলা শহরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে (কেএসআই) খিং সাই মং মারমার একক চিত্র প্রদর্শনীর শেষ দিন ছিল গতকাল সোমবার। চার দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী শুরু হয় ১৯ ডিসেম্বর। ‘রোয়া-দ্ব’ নামের এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে শিল্পীর জলরং ও তেলরঙে আঁকা ২৭টি ছবি।
শিল্পী খিং সাই মং মারমা প্রতিটি ছবিতে বান্দরবানের প্রাকৃতিক ও জাতিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের ছোঁয়া যেমন রয়েছে, তেমনি উঠে এসেছে হারানো সময়ের চালচিত্র। আদিবাসী ঐতিহ্যের শিকড়সন্ধানী শিল্পীর মনোভাবে পরিচয় মেলে প্রদর্শনীর নামকরণেও। ‘রোয়া-দ্ব’ নামে আয়োজিত এই প্রদর্শনী বান্দরবানের অতীতের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মারমা ভাষায় ‘রোয়া-দ্ব’ বলতে বান্দরবানকে বোঝায়। আরও পরিষ্কার করে বললে, ‘রোয়া-দ্ব’ হলো বোমাং সার্কেলের কেন্দ্রীয় গ্রাম বা রাজধানী।
শিল্পীর বেশ কয়েকটি ছবির শিরোনাম ‘অস্তিত্ব’। এই সিরিজের একটি ছবিতে দেখা যায়, কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল, কুকুরের পাশ ঘেঁষে বসে থাকা কয়েকটি পাহাড়ি শিশু শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উড়ন্ত পালকের দিকে। ছবিটি দর্শককে আচ্ছন্ন করে। আক্রান্ত করে। পাহাড়ের বাস্তবতা ও তার অনিশ্চয়তার দিকে টেনে নিয়ে যায়।
‘পাথর’ শিরোনামে একটি ছবিতে দেখা যায়, ঝিরি-ঝরনার পাথর দাঁড়িপাল্লায় তোলা হয়েছে, তার নিচে একটি কাঁকড়া। কোটি বছর ধরে বালুকণা জমে সৃষ্ট পাথর বিক্রি হচ্ছে, অপর দিকে এই পাথর যার আবাস, সেই কাঁকড়ার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠছে।
শিল্পী খিং সাই মং মারমার ছবিতে হাইপাররিয়েলিজম অর্থাৎ অতিবাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটেছে। ফটোগ্রাফির নিখুঁত ডিটেইল পাওয়া যায় তাঁর ছবিতে। একই সঙ্গে পরিপার্শ্বকে বদলে দেওয়া নতুন বাস্তবতাও আবিষ্কার করে দর্শক।
প্রকৃতিঘনিষ্ঠ ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবনের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে খিং সাইয়ের ছবিতে। শিল্পী খিং সাই মং বলেন, তাঁর শৈল্পিক পথচলায় পাহাড়ের ভূমি, ভূমিপুত্র ও তাদের জীবনযাত্রা ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছে। ছবিগুলো সেই গভীর অনুভূতির প্রতিফলন। খিং সাইয়ের এটি প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী। ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক এই ছাত্র এর আগে দলগতভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১৫টি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন।
চিত্র প্রদর্শনীতে সহযোগিতা করেছেন সেনাবাহিনীর বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম রাকিব ইবনে রেজওয়ান। সমাপনী অনুষ্ঠানে এস এম রাকিব ইবনে রেজওয়ান বলেন, শিল্পী খিং সাই মং মারমার এই প্রদর্শনী দেখে আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবেন। তাঁর ছবি ভবিষ্যতে পাহাড়কে আলোকিত করবে।