
বগুড়ার আদমদীঘিতে দেশের ঐতিহ্যবাহী সান্তাহার রেলওয়ে জংশন স্টেশন হয়ে প্রতিদিন পাঁচটি প্ল্যাটফর্মে যাত্রীবাহী ৪৪টি আন্তনগর ও মেইল ট্রেন চলাচল করে। দিনে-রাতে হাজারো যাত্রীর আনাগোনা থাকে এখানে। ব্যস্ত এ স্টেশনে যাত্রীদের জন্য বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট।
নেই শৌচাগারের ব্যবস্থা। ফলে যাত্রীদের স্টেশনের বাইরে গণশৌচাগারে যেতে হয়। কোনো কোনো পুরুষ যাত্রী প্ল্যাটফর্ম থেকে নিচে নেমে দাঁড়িয়েই করেন প্রস্রাব। কেউ কেউ আবার পাশে জঙ্গলে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে শৌচাগারের কাজ সারেন।
ব্রিটিশ আমলের এই স্টেশনের অবকাঠামোয় লাগেনি তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া। যাত্রীদের বিশ্রামের জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ১৪৭ বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এই জংশন স্টেশন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। স্টেশনটি হয়ে প্রায়ই ট্রেনে যাতায়াত করেন আদমদীঘির শাওইল বাজারের রাকিবুল হাসান। তিনি বলেন, প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এ রেলওয়ে জংশন স্টেশনে প্রস্রাব ও পায়খানা করার মতো টয়লেট নেই। অনেকেই স্টেশনের পাশের জোড়া পুকুর জঙ্গলে গিয়ে জরুরি কাজ সারেন।
ট্রেনের যাত্রী শিহাব উদ্দিন বলেন, স্টেশনে নেই নিরাপত্তাপ্রাচীর। এতে পকেটমার, ছিনতাইকারী, মাদক কারবারিদের অবাধ বিচরণ আছে। অরক্ষিত এই স্টেশনে বিনা টিকিটের যাত্রীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
সান্তাহার রেলওয়ে জংশন স্টেশন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৮৭৮ সালে ইস্টার্ন স্টেট কোম্পানি সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করে। একসময় সান্তাহার জংশন হয়ে ভারতের দার্জিলিং থেকে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন চলাচল করত। রেলওয়ে জংশনকে কেন্দ্র করে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন এই স্টেশনে আসতেন। এই স্টেশন ও জংশনেই প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমান ‘জনতা এক্সপ্রেস’ এবং আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রের শুটিং করেছিলেন। স্টেশনটি অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখলেও এটি আধুনিকায়নে কোনো উদ্যোগ নেই।
সান্তাহার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোরশেদ বলেন, শিলিগুড়ি থেকে শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত ‘ক্যালকাটা মেইল’ চলত। মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী আশ্রমে যাওয়ার পথে সান্তাহার রেলস্টেশনে নেমে চা পান করতেন। ১৯৪০ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সান্তাহারে এসে তাঁবু টাঙিয়ে সাত দিন এখানে অবস্থান করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সান্তাহার রেলস্টেশনে নেমে ডাক বাংলোয় উঠতেন। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতা এই রেলস্টেশনে আসতেন। নানা ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এই রেলস্টেশন।
ট্রেনের যাত্রী আনিসুর রহমান বলেন, জংশন স্টেশনে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। ব্রিটিশ আমলে তৈরি বিশ্রামাগারগুলোর দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার নেই। মান্ধাতা আমলে নির্মিত ভিআইপি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকলেও বসার পর্যাপ্ত আসন নেই। দিনে-রাতে শৌচাগার বন্ধ থাকে।বিশ্রামাগারগুলোয়ও অধিকাংশ সময় পানি থাকে না। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। যাত্রীদের খাবারের জন্য নেই কোনো মানসম্মত কোনো রেস্তোরাঁ। প্ল্যাটফর্মে বৈদ্যুতিক ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশ নষ্ট।
১৪ জানুয়ারি দুপুরে সরেজমিনে সান্তাহার রেলওয়ে জংশন স্টেশনে গিয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটের বিষয়টি বোঝা গেল। স্টেশন মাস্টারের কক্ষের পেছনে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য একটি ফিল্টার স্থাপন করা। কিন্তু সেটি অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে পানি পানের জন্য নেই কোনো মগ বা গ্লাস। তবে স্টেশনের দক্ষিণপাশে একটি মাত্র টিউবওয়েল আছে।
স্টেশনের পূর্ব প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছিলেন শিহাব নামে এক যাত্রী। প্রস্রাব শেষে আলাপকালে তিনি বললেন, ‘পাবলিক টয়লেট অনেক দূরে। এ কারণে দাঁড়িয়েই প্রস্রাব সারতে হয়েছে।’
আন্তনগর লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে নেমে এক নারী যাত্রী শৌচাগার খুঁজছিলেন। তিনি বললেন, বগুড়া থেকে এসে সান্তাহার স্টেশনে নেমেছেন। অন্য ট্রেনে দিনাজপুরে যাবেন। এর আগে টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু গোটা স্টেশনজুড়ে কোনো টয়লেট খোলা নেই।
সান্তাহার জংশন স্টেশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এই স্টেশন দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় যেসব ট্রেন চলাচল করে। সেগুলো মধ্যে আছে—রাজশাহী-চিলাহাটি রুটের আন্তনগর তিতুমীর এক্সপ্রেস, ঢাকা-চিলাহাটি রুটের চিলাহাটি এক্সপ্রেস, ঢাকা-চিলাহাটি রুটের নীলসাগর এক্সপ্রেস, খুলনা-চিলাহাটি রুটে রূপসা এক্সপ্রেস, ঢাকা-রংপুর রুটের রংপুর এক্সপ্রেস, ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের একতা এক্সপ্রেস, ঢাকা-বুড়িমারী রুটের বুড়িমারী এক্সপ্রেস, রাজশাহী-পঞ্চগড় রুটে বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস, ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের দ্রুতযান, ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটের আন্তনগর কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, খুলনা-চিলাহাটি রুটের সীমান্ত এক্সপ্রেস, ঢাকা-লালমনিরহাট রুটের লালমনি এক্সপ্রেস, ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, সান্তাহার-পঞ্চগড় রুটের দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস, সান্তাহার-বুড়িমারী রুটের করতোয়া এক্সপ্রেস, সান্তাহার-লালমনিরহাট রুটের বগুড়া মেইল ও পদ্মরাগ এক্সপ্রেস, সান্তাহার-বোনারপাড়া রুটের মেইল ট্রেন, রাজশাহী-পার্বতীপুর রুটের উত্তরা মেইল, খুলনা-চিলাহাটি রুটের রকেট মেইল, ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি রুটের আন্তনগর মিতালী এক্সপ্রেস এবং রাজশাহী-চিলাহাটি রুটের বরেন্দ্র এক্সপ্রেস। এই স্টেশনে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ১০ হাজার যাত্রী ওঠানামা করেন।
স্টেশনে কুলি-মজুরের কাজ করেন ইমদাদুল হক। তাঁর ভাষ্য, গোটা রেলস্টেশনজুড়ে মাত্র একটি টিউবওয়েল। মাঝেমধ্যেই সেটি অকেজো থাকে। আছে খাবার পানির প্রকট সংকট। অথচ একসময় এখানে খাবার পানির ১০টি চাপ কল ছিল। পাওয়া যেত গরম ও ঠান্ডা পানি।
স্টেশনের খাবারের হোটেল ভোজনালয়ের ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন বলেন, স্টেশনে যাত্রীদের জন্য টয়লেট থাকলেও তা তালাবদ্ধ থাকে। তাই বাধ্য হয়ে যাত্রীদের পাবলিক টয়লেটে গিয়ে ১৫ টাকা গুনতে হয়।
সান্তাহার জংশন স্টেশনের স্টেশন মাস্টার খাদিজা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম শ্রেণি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য দুটি টয়লেট আছে। দ্বিতীয় শ্রেণির নারী যাত্রীদের জন্য টয়লেট আছে। সেটা দেখভালর জন্য কোনো জনবল নেই। ফলে নিরাপত্তার জন্য টয়লেট তালাবদ্ধ রাখতে হয়। স্টেশনে খাবার পানির সংকট আছে। তবে রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি যাত্রীদের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। স্টেশনের অন্যান্য সমস্যা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
জংশন স্টেশন থেকে ট্রেন চড়ে নিয়মিত ব্যবসার কাজে ঢাকা ও খুলনায় যাতায়াত করেন নওগাঁর ব্যবসায়ী আলম হোসেন। তিনি জানান, স্টেশনে বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম আছে। কিন্তু একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে পারাপারের জন্য পদচারী–সেতু নেই। ফলে বাধ্য হয়ে যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাতায়াত করতে হয়। রেললাইন থেকে উঁচু প্ল্যাটফর্মে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য এক যাত্রী অন্য জনের হাত ধরে টেনে তোলেন।