সকাল বাজারে শাক কিনছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল হামিদ। আজ মঙ্গলবার
সকাল বাজারে শাক কিনছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল হামিদ। আজ মঙ্গলবার

‘সবজি কিনতেই জীবন শেষ, মাছ-মাংসের চিন্তা করার সাহসই পাই না’

শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল হামিদের (৬৫) সংসারে তিনি আর তাঁর স্ত্রী। ছোট্ট একটি বসতভিটাই তাঁদের একমাত্র সম্বল। ভিক্ষাবৃত্তিতেই চলে সংসার। মাস শেষে হাতে আসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আজ মঙ্গলবার ভোরে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন হামিদ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোদে আর প্রচণ্ড গরমে ঘুরে পেয়েছেন ২০০ টাকা। সেই টাকা নিয়েই পা বাড়ান বাজারের দিকে। কিনেছেন ২৫০ গ্রাম রসুন, একটি লাউ, কিছু আলু আর কয়েক আঁটি শাক। এতেই শেষ হয়ে যায় তাঁর দিনের সম্বল। মাছ-মাংসের দোকানের দিকে একবার তাকিয়েছিলেন বটে, কিন্তু পা বাড়াতে পারেননি। চোখে ছিল কেবল অসহায় এক দীর্ঘশ্বাস। শাকসবজি হাতে ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছিলেন বাড়ির পথে।

আজ দুপুর ১২টার দিকে জামালপুর শহরের সকাল বাজারে কথা হয় আবদুল হামিদের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি ইসলামপুর উপজেলার কলাবান্দা এলাকায়। শরীর ভালো থাকলে তিনি প্রতিদিন জামালপুর শহরে ভিক্ষা করতে আসেন। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন, কিন্তু মা–বাবার খোঁজখবর রাখেন না। একসময় রিকশা চালাতেন হামিদ। কিন্তু পায়ের সমস্যার কারণে এখন আর পারেন না। তাই ভিক্ষা করেই কোনো রকমে স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটান।

আবদুল হামিদ বলেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনি মাথা ঘুরি যায়। কত কষ্ট করে কইটা ট্যাহা পাই। সেই ট্যাহা নিয়ে বাজারে গেলে কোনোডারই লাগাল পাই না। শাক, আলু আর বেগুনের যে দাম, মাছ-গোশত কিনার সাহস পাইনে। দেহুন ওই সকাল থ্যাইকা যে কইডা ট্যাহা পাইলাম, লাউ, আলু আর শাক কিনতেই শেষ। দুজন মানুষ খাই, তাই চলতি পারছি না।’

জামালপুর শহরের সবচেয়ে বড় সকাল বাজার ঘুরে আজ সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেখা গেছে, পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে, বেগুন ১২০ থেকে ১৪০, আলু ২৫, মরিচ ১৫০ থেকে ১৬০, শসা ৮০ থেকে ১০০, করলা ৮০ থেকে ১০০, টমেটো ১০০ থেকে ১২০, শিম ১৫০ থেকে ১৬০, পেঁপে ২০, পটোল ৫০ থেকে ৬০, বরবটি ১০০, লেবু ৮০, ঢ্যাঁড়স ৬৫, বিভিন্ন শাক ৪০ এবং মিষ্টিকুমড়া ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। লাউ প্রতিটি ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শহরের শফি মিয়ার বাজার, বানিয়া বাজার, ফৌজদারি মোড় বাজার ও বউ বাজারেও প্রায় একই দামে এসব শাকসবজি বিক্রি হচ্ছে।

সবজির চড়া দামে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। আজ মঙ্গলবার

সকাল বাজারের সবজির দোকানি রাফিউল ইসলামের দোকানে সবজি কিনতে আসেন শহরের ভোকেশনাল মোড় এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ কাফি। তিনি বলেন, ‘প্রায় শীত চলে আসছে। তারপরও বাজারে সবজির দাম কমেনি। আগের মতোই সব সবজির দাম। সবজি কিনতেই জীবন শেষ। মাছ-মাংসের চিন্তা করার সাহসই পাই না। ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালাই, মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা আয় হয়। এর বেশির ভাগই যায় দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল আর ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ায়। অনেক মাসে ঋণ করে সংসার চালাতে হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনে মাথা ঘুরে যায়। তাই কম কম কিনে কোনো রকমে চলছি। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতা রাফিউল ইসলাম বলেন, বেশি দামে সবজি কিনতে হয়েছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করছে। তবে এই সপ্তাহে কোনো সবজির দাম বাড়েনি, আগের দামই রয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কিছু সবজির দাম কমতে পারে। সামনে শীত আসছে, তখন সবজির সরবরাহ বাড়বে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দাম কিছুটা কমবে।

বাড়তি দামে সবজি কিনতে গিয়ে ঘাম ঝরছে নিম্ন আয়ের মানুষের। ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারে কোনো কিছুই এখন নাগালের মধ্যে নেই। চাহিদা ও সরবরাহের অসামঞ্জস্য, আর মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতবদলে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে প্রতিদিনের কেনাকাটায় অতিরিক্ত খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিক্রেতারা বলছেন, এবার টানা বৃষ্টির কারণে সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সরবরাহ কমেছে। শীত মৌসুমের আগে শাকসবজির উৎপাদন কম হওয়ায় পাইকারি বাজারেও সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তাই দাম কমছে না। তবে নভেম্বর মাসে দাম কিছুটা কমবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

জামালপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলম শরিফ খান বলেন, এবার দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষক আগাম সবজি চাষ করতে পারেননি। যেটুকু করেছেন, তার বেশির ভাগই নষ্ট হয়েছে। তাই বাজারে সবজির সরবরাহ কম। সরবরাহ কম থাকায় দামও কমছে না। তবে আগামী মাসের মধ্যে শীতের সবজি আসবে, তখন দামও কমে যাবে।